গোধরা পরবর্তী দাঙ্গায় নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে তার নিষ্ক্রিয়তার জন্য আজ সরাসরি দুষল গুজরাত হাইকোর্ট। রীতিমতো ভর্ৎসনার সুরে আদালত জানিয়েছে, ২০০২ সালের দাঙ্গা মোকাবিলায় কার্যত হাত গুটিয়ে বসেছিল বিজেপি সরকার। আর সেই জন্যই গোটা গুজরাত জুড়ে নৈরাজ্য চলেছে। দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় পাঁচশোটি ধর্মীয় কাঠামো সারানোর জন্য গুজরাত সরকারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশও দিয়েছে আদালত।
গুজরাত হাইকোর্টে ‘ইসলামিক রিলিফ কমিটি অফ গুজরাত’ (আইআরসিজি)-এর করা একটি আবেদনের শুনানি ছিল আজ। সেখানেই ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি ভাস্কর ভট্টাচার্য ও বিচারপতি জে বি পারদিওয়ালার ডিভিশন বেঞ্চ এক হাত নিয়েছে মোদী সরকারকে। আদালত বলেছে, “দাঙ্গা মোকাবিলায় গুজরাত সরকারের সক্রিয়তার যথেষ্ট অভাব ছিল। সেই জন্য গুজরাত জুড়ে সেই সময় নৈরাজ্যের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। এবং তা চলেওছিল বেশ কিছু দিন।” রাজ্য সরকার কখনওই তার দায়িত্ব থেকে সরে আসতে পারে না, রায় দিতে গিয়ে এমনটাই জানিয়েছে হাইকোর্ট। বিজেপি সরকার যে সেই সময় দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়নি, আজকের রায়ে সে কথা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। আইআরসিজি-র আইনজীবী এম টি এম হাকিম এই রায়কে নজিরবিহীন আখ্যা দিয়ে বলেছেন, “সম্ভবত এই প্রথম কোনও আদালত গোধরা পরবর্তী গুজরাত দাঙ্গা মোকাবিলায় মোদী সরকারের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে সরাসরি মুখ খুলল। সরকারকে দায়িত্বজ্ঞানহীনও বলল।”
এর আগে গুজরাত হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা হয়েছিল মোদীর বিরুদ্ধে। যেখানে আবেদন করা হয়েছিল, গোধরা পরবর্তী দাঙ্গার তদন্তে নিয়োজিত নানাবতী কমিশন যেন মোদীকে সমন পাঠায়, তেমনই নির্দেশ দিক আদালত। কিন্তু আদালত সেই আর্জি খারিজ করে দেয়। গত বছর গুলবার্গ সোসাইটি গণহত্যা মামলায় সুপ্রিম কোর্টও শেষ পর্যন্ত নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখারই সিদ্ধান্ত নেয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই ওই মামলায় বিশেষ তদন্তকারী দল গঠিত হয়েছিল। তারা মোদীর সাক্ষ্যও নিয়েছিল। কিন্তু তাদের রিপোর্ট জমা পড়ার পরে নিজের রায়ে শীর্ষ আদালত বলে যে, তারা এর মধ্যে ঢুকতে চায় না। মামলার বিচারের ভার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের উপরেই থাকবে। গুজরাত দাঙ্গা সংক্রান্ত পরপর এই দু’টি রায়ে মোদী কিছুটা অব্যাহতি পাওয়ায় স্বভাবতই উৎফুল্ল ছিল বিজেপি শিবির। উপরন্তু ২০০৮ সালে গোধরায় সাবরমতী এক্সপ্রেসের কামরায় অগ্নিকাণ্ড নিয়ে নানাবতী কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ পেয়েছে। সেখানেও রেল মন্ত্রকের কাছে উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কমিশন যে রিপোর্ট দাখিল করেছিল, তার সম্পূর্ণ উল্টো তথ্য পেশ করা হয়েছে। নানাবতী কমিশন গোধরার ঘটনায় পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের কথাই বলেছে। সেটাও মোদীকে রাজনৈতিক সুবিধা দিয়েছে।
কিন্তু গুজরাত হাইকোর্টে আজকের রায় প্রত্যক্ষ ভাবে দাঙ্গায় মোদীর নিষ্ক্রিয়তার কথা বলল। আদালত জানিয়েছে, দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘর-বাড়ি বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার যে ভাবে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে, ধর্মীয় কাঠামোর ক্ষেত্রেও ঠিক একই নিয়ম কার্যকর করতে হবে। এর জন্য গুজরাতের ২৬টি জেলার মুখ্য দায়রা বিচারকের কাছে আবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। কোন কোন ক্ষতিগ্রস্ত কাঠামোর ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, তা নির্ধারণের দায়িত্ব মুখ্য দায়রা বিচারকদের উপরই ছেড়ে দিয়েছে আদালত। আগামী ছ’মাসের মধ্যে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে হাইকোর্টের নির্দেশ।
দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত ধর্মীয় কাঠামোগুলির জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে ২০০৩ সালেই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল আইআরসিজি। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও সেই সময় আইআরসিজি-র ওই আবেদনকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু বেঁকে বসে বিজেপি সরকার। আবেদনের বিরোধিতা করে মোদী সরকার তখন বলেছিল, কোনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য কর চাপানো মানে ভারতীয় সংবিধান লঙ্ঘন করা। কিন্তু রাজ্য সরকারের সেই বিরোধিতাকে হাইকোর্ট আমল দেয়নি।
এই রায় শোনার পরে স্বভাবতই বিজেপির বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছে কংগ্রেস। দিল্লিতে কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক বি কে হরিপ্রসাদ বলেছেন, “সুপ্রিম কোর্ট থেকে শুরু করে যে কোনও আদালত, দাঙ্গা হোক বা ভুয়ো সংঘর্ষ, মোদীকেই প্রাথমিক ভাবে অভিযুক্ত করেছে।” তবে বিজেপির তরফ থেকে এই রায় নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। দলের মুখপাত্র রাজীবপ্রতাপ রুডি শুধু বললেন, “আগে হাইকোর্টের রায় পুরোপুরি জানি। তার পরেই এই বিষয় নিয়ে মুখ খুলব।”
|