মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত আশ্বাস সত্ত্বেও রাজারহাটে তোলাবাজদের দাপট অব্যাহত। তথ্যপ্রযুক্তি দফতরে চিঠি দিয়ে ইতিমধ্যেই অভিযোগ জানিয়েছে তোলাবাজিতে জেরবার কয়েকটি সংস্থা। অবিলম্বে পরিস্থিতি না বদলালে এ রাজ্যে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে বিনিয়োগ ধাক্কা খেতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট মহলের আশঙ্কা। তবে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, বিষয়টির উপর নজর রাখা হচ্ছে। কোনও রকম রাজনৈতিক রং না দেখেই সরকার কড়া ব্যবস্থা নেবে।
ক্ষমতায় আসার ঠিক পরেই যে কোনও রকম তোলাবাজির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে দলীয় বৈঠকে ‘হুঁশিয়ারি’ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর আমলে প্রথম শিল্প প্রকল্পের শিলান্যাস অনুষ্ঠানেও শিল্পপতিদের তিনি বলেছিলেন, “আমাদের দলের নাম করে কেউ টাকা চাইলে দেবেন না। এটা আপনাদেরও বন্ধ করতে হবে।”
কিন্তু স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর এই হুঁশিয়ারিতেও বিশেষ কাজ হয়নি রাজারহাট-নিউটাউন অঞ্চলে। রাজারহাটে ৪৫ একরের বেশি জমি জুড়ে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের বিশেষ আর্থিক অঞ্চল ‘ইউনিটেক ইনফোস্পেস’। বেশ কয়েকটি শীর্ষ তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা এই আর্থিক অঞ্চলে জমি লিজ বা ভাড়া নিয়ে অফিস করেছে। সব মিলিয়ে এখানে কাজ করেন প্রায় ১৫ হাজার মানুষ। স্থানীয় সূত্রের খবর, এই এলাকার সামনেই অস্থায়ী ডেরা তোলাবাজদের।
চড়া দামে নিচু মানের ইমারতি দ্রব্য কেনার জন্য চাপ সৃষ্টির অভিযোগ আগেও ছিল। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তোলাবাজির সমস্যা। যে কোনও রকম মাল নিয়ে ঢুকতে গেলেই তোলা আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ। কিছু দুষ্কৃতী আরও এক ধাপ এগিয়ে অফিসে ঢুকে চাকরি দাবি করছে বলেও অভিযোগ তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির। কর্মীদের যাতায়াতের পথে ভয় দেখানো হচ্ছে। ডেবিট কার্ড কেড়ে নিয়ে জোর করে টাকা তোলানোর অভিযোগও রয়েছে।
কী ধরনের পরিবেশের মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে, তার বিবরণ জানিয়েই রাজ্য সরকারের কাছে চিঠি দিয়েছে ক্যাপজেমিনি, জেনপ্যাক্ট, টিসিএস এবং কগনিজেন্ট। তারা হিডকো এবং পুলিশকেও লিখিত ভাবে তাদের অভিযোগ জানিয়েছে বলে তথ্যপ্রযুক্তি মহলের দাবি। তবে বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চাননি অভিযোগকারী কোনও সংস্থার কর্তাই। রাজ্য সরকার কী পদক্ষেপ করে তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন তাঁরা। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পমহলও রাজ্য সরকারের ‘দাওয়াই’-এর দিকে তাকিয়ে। তাদের মতে, সমস্যা এখনই না মেটালে ভবিষ্যৎ লগ্নির উপরে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
রাজারহাটে তোলাবাজির অভিযোগ এর আগেও উঠেছে। গত বছর জুলাই মাসে ইউনিটেক ইনফোস্পেসে ঢোকার মুখে গোদরেজের লরি আটকে দেওয়া হয়। লরি প্রতি ৫০০০ টাকা দাবি করে দুষ্কৃতীরা। হুমকি দেয়, টাকা না-দিলে শুধু মাল সরবরাহ বন্ধ নয়, লোকজনদেরও আটকে রাখা হবে। ১৮ই জুলাই রাজারহাট থানায় অভিযোগ দায়ের করে গোদরেজ। পরে বিষয়টি ‘আপসে’ মিটিয়ে নিয়ে কাজ করা সম্ভব হয়েছে বলে সংস্থা সূত্রের খবর।
কিন্তু সমস্যা যে মেটেনি, বরং আরও বেড়েছে তা তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাদের চিঠিতেই স্পষ্ট। এ রকমই তোলাবাজির শিকার ব্রিটেনের একটি সংস্থা। ভারতে পা-রাখতে কলকাতাকেই বেছে নিয়েছে তারা। ইউনিটেকের বিশেষ আর্থিক অঞ্চলের কাছেই তাদের জমি। অভিযোগ, তোলাবাজির কারণে সেখানে নির্মাণ কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। ইউনিটেক ইনফোস্পেসের সংস্থাগুলির চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কী ব্যবস্থা নেয় তা দেখেই পরবর্তী পরিকল্পনা ঠিক করবে বিদেশি এই সংস্থা।
শুধু বেসরকারি সংস্থাই নয়, রাজারহাটে তোলাবাজির শিকার হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ওএনজিসি। তাদের ৩৩৯ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ এক সময় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে অভিযোগ। পরে প্রশাসন ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপে বিষয়টি মিটে যায়। রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী অবশ্য তোলাবাজি সম্পর্কে কড়া মনোভাবের কথাই জানিয়েছেন। পার্থবাবুর সাফ বক্তব্য, “শিল্পের উন্নয়ন আটকে যাবে, এমন কোনও কাজ বরদাস্ত করা হবে না। অভিযোগ প্রমাণ হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রশাসনকে নজর রাখতে বলা হয়েছে।” আর বিধাননগর কমিশনারেট-এর ডেপুটি কমিশনার (সদর) সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” |