দিল্লিতে শিল্পমেলা
প্রযুক্তির ব্যবহার স্বাগত, সাবেক চিত্ররীতিও অম্লান
কটা বিরাট ফাঁকা ঘরের এক কোণায় বিভিন্ন উচ্চতায় বসানো প্লাই-এর টেবিল। তাতে নির্দিষ্ট ব্যবধানে সাজানো মাঝারি উচ্চতার বেশ কিছু দুধ-সাদা বোতল। যার মধ্যে গোঁজা আছে মাইক্রো কন্ট্রোলার, সেন্সর এবং ক্ষুদে স্পিকার।
দর্শকরা যখনই কাছে যাচ্ছেন, সেন্সর কাজ করতে শুরু করছে। প্রায় গুঞ্জনের মতো আওয়াজ। প্রতিদিনের বিভিন্ন শব্দ ছেঁকে তৈরি।
এই ‘শব্দকল্পদ্রুম’টি আসলে একটি নিরীক্ষামূলক দৃশ্যকলা, যেখানে শব্দ ভিন্ন মাত্রা এনে দিচ্ছে দর্শন অভিজ্ঞতায়। নয়াদিল্লির সদ্যসমাপ্ত চতুর্থ ‘ইন্ডিয়ান আর্ট ফেয়ারে’ এমন ‘ইনস্টলেশন’-এর উদাহরণ এ বার নজর কাড়া। চিরাচরিত তেলরঙ, জলরঙ অথবা মিশ্র মিডিয়ার কাজের পাশাপাশি প্রযুক্তির ব্যবহার, ভিডিওগ্রাফি, ইনস্টলেশন আর্ট-এর যথেচ্ছ উপস্থিতি। কোথাও লাল রং করা লোহার ভ্যান রিক্সার উপর উল্টো করে বসানো রয়েছে এক ঝাঁক মাইক। কোথাও উপর থেকে ঝুলন্ত একগুচ্ছ প্লাস্টিকের বোতলে এমন ভাবে আলোকসম্পাত করা, যাতে তাদের সম্মিলিত ছায়া উল্টো দিকের দেওয়ালে তৈরি করেছে মুখাবয়ব। কোথাও আবার কাচ ও ফাইবারের মিশ্রণে ‘বিরাট শিশু’।
পরেশ মাইতির ইনস্টলেশন, ‘মেমোরি
এক দিকে সনাতন এবং অন্য দিকে এই প্রযুক্তিনির্ভর, ত্রিমাত্রিক কাজের মধ্যে কোথাও কি বিরোধ রয়েছে? নাকি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কদর কমছে ক্যানভাসের উপর তুলির টানের? শিল্প মহলের বক্তব্য, পরিবর্তন অনিবার্য। কিন্তু তার জন্য এত দিনের শিল্পধারা উবে যাবে বা তার বাজারদর কমবে, বিষয়টি সে রকম নয়। তবে উদ্যোক্তাদের বক্তব্য, ২০টি দেশের ৯৮ জন শিল্পীর এই মহামেলায় চিরাচরিত তৈলচিত্রগুলির পাশাপাশি এই সব নিরীক্ষামূলক কাজের কক্ষগুলিতে ভিড় ছিল অন্যান্য বারের চেয়ে অনেকটা বেশি। নতুন কিছু দেখার কৌতূহলে মজেছেন শিল্পরসিকরা।
কেন? শিল্পী যোগেন চৌধুরী মনে করছেন, “নতুন ধরনের কাজ করা হলে তাকে ঘিরে একটা উদ্দীপনা তৈরি হবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে সে জন্য পুরনো ঘরানা নষ্ট হয়ে যাবে, এটা আমি মনে করি না।” তাঁর কথায়, “আধুনিকতা আসলে মননের বিষয়। কাদা বা মাটির মতো প্রাগৈতিহাসিক মাধ্যম দিয়েও তো উত্তরাধুনিক কাজ করা সম্ভব। হচ্ছেও।” অর্থাৎ চিরাচরিত পরিচিত মাধ্যম দিয়েও একদম নতুন কোনও কাজ করা সম্ভব। যোগেনবাবু মেনে নিচ্ছেন যে, অনেক ক্ষেত্রে প্রযুক্তি এবং যন্ত্র কাজটা সহজ করে দেয়। কিন্তু সবার আগে যেটা প্রয়োজন, তা হল আধুনিকতার বোধটি শিল্পীর নিজের কাছে স্পষ্ট হওয়া। তাঁর কথায়, “এখনও দ্বিমাত্রিক তেলরঙের ক্যানভাসে অজস্র নতুন রকমের নিরীক্ষামূলক কাজ হচ্ছে।”
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিক্স-প্রিন্ট মেকিং-এর বিভাগীয় প্রধান এবং দৃশ্যকলা বিভাগের ডিন পরাগ রায়ের বক্তব্য, এই দুই ধারার মধ্যে আসলে কোনও বিরোধ নেই। “আমার নিজের বিভাগটি তো সম্পূর্ণ প্রযুক্তি নির্ভর। ক্যামেরা বা কম্পিউটার না তুলি সেটা বিষয় নয়। আসল কথা হল, তা শেষ পর্যন্ত শিল্প হয়ে উঠতে পারছে কি না।” ফোটোগ্রাফি এবং ভিডিও আর্ট-এর জগতে সুপরিচিত নাম জিতিশ কাল্লাটও মনে করেন, কোন মাধ্যমে কাজটি করা হচ্ছে তা একেবারেই গৌণ। তাঁর কথায়, “সময় বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে পেনসিল এবং পিক্সেল উভয়েই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যে কাজটি করা হচ্ছে তার যদি প্রাসঙ্গিকতা থাকে, তা হলে যে কোনও মাধ্যমেই তা করা সম্ভব।” তবে এই প্রসঙ্গে একটি প্রশ্ন অবশ্য তুলছেন পরাগবাবু। “নতুন ধারার যে কাজ হচ্ছে, তার সঙ্গে শিল্পীর দেশ-মাটি-ধর্ম-সংস্কৃতির ঐতিহ্য মিশে থাকছে তো? এই বিষয়টি নিয়ে বোধহয় ভাবার সময় এসেছে।”
শিল্পী পরেশ মাইতি নিজেই জলরঙের পাশাপাশি অক্লান্ত ভাবে ইনস্টলেশনের কাজ করে যাচ্ছেন। এ বারের শিল্পমেলায় তাঁর করা ইনস্টলেশন দেখতে প্রত্যেক দিন ভিড় করেছেন রসিক মানুষ। পরেশবাবু জানাচ্ছেন, কবিতা এবং গানের ক্ষেত্রে যেমন নতুন ভাষা ও ভাবনা তৈরি হয়েছে, তেমনই দৃশ্যকলাতেও ঘটেছে তার প্রতিফলন। “শিল্প নিজের প্রকাশের জন্য খুঁজে নিচ্ছে নতুন বাহন ও মাধ্যম। কিন্তু আসল কথাটা হল, সাবেকি (ক্লাসিক) কাজের গুরুত্ব যেমন যুগ যুগ ধরে টিঁকে থেকেছে, ভবিষ্যতেও তাই থাকবে। জলরং অথবা তৈলচিত্রের আবেদন চিরন্তন।” সহজ উদাহরণ দিলেন পরেশবাবু “যন্ত্রসঙ্গীতে প্রযুক্তির এখন বিরাট ভূমিকা। কিন্তু কিশোরকুমার বা আশা’র গান কি মানুষ ভুলে গিয়েছেন?”
নতুন শিল্পীদের পাশাপাশি কিশোর বা আশার সিডি-র বাজার তো এখনও টানটান! চিত্রশিল্পের বাজার কোন দিকে ঝুঁকছে? সিমা গ্যালারির কর্ণধার রাখী সরকারের কথায়, “ইনস্টলেশনের বাজার খুব উজ্জ্বল, এটা আমি মনে করি না। গোটা বিশ্বেই দেখা গিয়েছে একমাত্র জনস্থানে শিল্প (পাবলিক আর্ট) তৈরির ক্ষেত্রেই এর চাহিদা রয়েছে। কোনও বাড়িতে বা অফিসে এতটা জায়গা দিয়ে এই ধরনের কাজ রাখার কথা কেউ ভাবেন না।” গুহাপ্রাচীর থেকে শুরু করে ক্যানভাস ছবি আঁকার যে মূল স্রোত প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে চলে এসেছে, সেটা চিরকালই থাকবে বলে তাঁর বিশ্বাস।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.