শনিবারের নিবন্ধ
ভিটে বাস্তু
বিশ্বের সব থেকে দামি বাড়ি। ফাঁকা পড়ে আছে।
কেন?
মালিকের নাম মুকেশ অম্বানী। বাড়ির নাম অ্যান্টিলিয়া। মুম্বইয়ে ১০০ কোটি ডলার খরচ করে বানানো প্রাসাদে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করছেন অম্বানীরা। অথচ রাত কাটাচ্ছেন না। কারণ?
বাড়ির পুব দিকে যতগুলো জানলা থাকার কথা ততগুলো নেই। বাড়ির কুষ্ঠি মিলছে না।
বাড়ি তাই অশুভ। বাড়ির আবার কুষ্ঠি কী? কুষ্ঠি তো মানুষের হয়!
আজ্ঞে না। বাড়ি, জমি, সব কিছুরই কুষ্ঠিবিচার বেশ কিছু বছর ধরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে এ জ্যোতিষশাস্ত্র নয়, বাস্তুশাস্ত্র। মুম্বই হোক বা দিল্লি, বেঙ্গালুরু বা হায়দরাবাদ, পৃথিবীর ধনীতম মানুষ থেকে চাকুরিজীবী, সবাই কখনও না কখনও বাস্তু পরামর্শদাতার শরণ নিচ্ছেন। আর কলকাতা? এখানে তো শপিং মল থেকে আবাসন প্রকল্পভিতপুজোর আগে বাস্তুর পরামর্শ নেওয়াটা মাস্ট। অবিশ্বাসী তাই বলে কি নেই? নিশ্চয়ই আছেন। এবং সংখ্যাটা নেহাত মন্দ নয়। তবে বিশ্বাসীরা তাতে হাল ছাড়ছেন না।
রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। অভিনেত্রী। বিশ্বাস করেন তাঁর জীবনের ভাল-মন্দে বাস্তুর একটা বিরাট ভূমিকা আছে। কলকাতার গল্ফ ক্লাবের ফ্ল্যাট ভেঙেচুরে বাস্তু মেনে পাল্টেছেন। মুম্বইয়ের ফ্ল্যাটে অতটা সম্ভব হয়নি। “তার ফলও পেয়েছি হাতেনাতে। মুম্বইয়ের ফ্ল্যাটে কতটা ক্ষতি হয়েছে এবং কেন সেটা আমি নিজেই বুঝতে পেরেছি।” কলকাতার বাড়িতে যে ঘরে তাঁর আলমারি থাকে সেখানে বাস্তু নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছিলেন রূপা। “একটা আলমারি ইচ্ছে করে ভুল জায়গায় রাখতাম। বারবার। এ দিক। ও দিক। শেষে ঠিক জায়গায় রেখে ফল পেলাম। এটা কাকতালীয় হতে পারে না।”
এক দিকে সেলিব্রিটি রূপা। তো অন্য দিকে চাকরিজীবী সাংবাদিক সুস্মিতা চৌধুরী। “পড়াশোনায় মেয়ে একেবারে অমনোযোগী ছিল। টিউটর, বকাঝকা, আংটি, কোনও কিছুতেই কাজ দিচ্ছিল না,” বলছেন তিনি। চার দিকে বাস্তু নিয়ে এত হইচই শুনে সুস্মিতা একদিন কপাল ঠুকে চলেই গেলেন এক বাস্তু কনসালট্যান্টের কাছে। তিনি বিধান দিলেন মেয়ের পড়ার ঘরটা পাল্টাতে হবে। পশ্চিম দিক থেকে আনতে হবে পুবদিকে। তার পর? “ম্যাজিকের মতো ফল পেয়েছি। মেয়ে পড়াশোনায় মন তো দিয়েইছে। রেজাল্টও ভাল হচ্ছে,” বলছেন সুস্মিতা।
বাস্তুমুগ্ধ সুস্মিতা এখন নিজের বাড়ির তিন তলা তুলছেন। এবং সেটা তাঁর বাড়ির একতলা-দোতলার নকশা ভেঙে। পুরোপুরি বাস্তু বিধি মেনে। এগুলো কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এই শহরে ফ্ল্যাট কেনার আগে অধিকাংশ ক্রেতাই আজকাল বাস্তু সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে চান। প্রণব চট্টোপাধ্যায় আর্কিটেক্ট এবং ডেভেলপার। কলকাতার বহু বিখ্যাত জনই তাঁর গ্রাহক। বলছেন, “শুধু সেলেব না। সাধারণ মানুষও অনুরোধ জানান বাস্তুসম্মত বাসস্থানের জন্য। এঁরা অনেকেই বাস্তু সম্বন্ধে বিশেষ জানেন না। শুধু এইটুকু জানেন, বাস্তু মানলে জীবনে সুখশান্তি আসবে।”
এই সুখশান্তির তাগিদই হয়তো আজকের দুনিয়ায় বড় তাগিদ। “জীবনে টেনশন যত বাড়ছে ভাল থাকার তাগিদও তত বাড়ছে। বাস্তু নিয়ে মাতামাতির এটা একটা বড় কারণ। তা ছাড়া, যেখানে সেখানে যেন-তেন-প্রকারেণ বড় বড় ফ্ল্যাট বাড়ি গজিয়ে উঠছে। যেটা স্বাভাবিক জল-বাতাসের চলাচলকে বিঘ্নিত করে। বাস্তু মেনে ফ্ল্যাট কেনার একটা বড় কারণ আলো হাওয়া আছে এমন একটা আস্তানা পাওয়া। তাতে মন ও শরীর ভাল থাকে,” বলছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপিকা বুলা ভদ্র। কিন্তু অবিশ্বাসীরা মানলে তো! যুধাজিৎ বসু। এমন একটা চাকরি করেন যেখানে শুধু তিনি নন তাঁর পরিবারের নিরাপত্তাও মাঝেমধ্যে প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়। তাঁর কথায়, “আমার চাকরিতে পদে পদে বুদ্ধি আর ঝুঁকি নেওয়ার সাহসের প্রয়োজন। সেখানে আমার বেডরুম কোন দিকে আর আলমারি কোন কোণে তা দিয়ে জীবন চলবে না। যেমন চলবে না হাতে পলা বা রুবি পরে। আমার আত্নবিশ্বাসই আমার একমাত্র অস্ত্র।” কিন্তু সবাই তো যুধাজিৎ নন। আত্মবিশ্বাসের জায়গায় অতিলৌকিকতার আশ্রয় খোঁজেন অনেকেই। কলকাতার রিয়্যাল এস্টেটের ট্রেন্ড অন্তত তাই বলছে। অম্বুজা রিয়্যালটির এক উচ্চ-আধিকারিক জানাচ্ছেন, ফ্ল্যাট কেনার আগে ক্রেতারা আজকাল প্রথমেই জানতে চান ফ্ল্যাটে ঢোকার মূল দরজা কোন দিকে।
মুম্বইতে ফাঁকা পড়ে থাকা অম্বানীদের সেই ১০০ কোটি ডলারের প্রাসাদ।
“সদর দরজা যে দিকে, সেটা মাথায় রেখেই বাড়ির নিকাশি ব্যবস্থা বা বিদ্যুৎ ব্যবস্থার প্ল্যানিং করতে হয়। দেখতে হয় যাতে এগুলো উত্তর-পূর্ব দিকে না থাকে। বাস্তু মেনে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের ফ্ল্যাটের থেকে উত্তর-পূর্ব দিকের ফ্ল্যাটের উচ্চতাও কম রাখতে হয়,” বলছেন তিনি।
অর্থাৎ, বাস্তু এখন ঘোর বাস্তব।
ঘরের ঠাকুরের আসন থেকে অফিসে বসের চেম্বারের মুখ কোন দিকে থাকলে ভাল ফল পাওয়া যায় সবই ঠিক করে বাস্তু। যেমন, বাস্তু মতে টাকা-পয়সা বা মূল্যবান বস্তু সেই আলমারিতেই রাখা উচিত যা উত্তর দিকে বসানো। আবার টিউব ওয়েল যদি উত্তর দিকে বসে সেটা টাকাপয়সার ক্ষতি আনে। অফিস চত্বরে মন্দির কখনওই মালিকের চেয়ারের পিছন দিকে হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। বাড়িতে আয়নার বা কিছু-কিছু দেবদেবীর অধিষ্ঠানের ওপরও নির্ভর করে বাড়ির মঙ্গল। অভিনেত্রী পাওলি দাম নতুন ফ্ল্যাট কিনেছেন। বলছিলেন, “অত বুঝি না। আমার দক্ষিণ আর পূর্ব খোলা ফ্ল্যাটের ইচ্ছে ছিল। বাস্তুর প্ল্যানিংয়ের সঙ্গে সেটা মিলে গেছে।”
তবে বাস্তুর আরও খুঁটিনাটি আছে। “রান্নাঘরে আগুন জ্বলে। তাই পূর্বদিকে সুর্যোদয়ের মুখোমুখি রান্নাঘর হলে সংসারে সমৃদ্ধি হয়,” জানাচ্ছেন বাস্তু কনসালট্যান্ট আর কে আনন্দ। বাথরুম সম্বন্ধেও তাঁর বক্তব্য আছে। “বাথরুম উত্তর পশ্চিম বা পশ্চিম দিকে হলে মঙ্গলের। কিন্তু বাথরুম আর রান্নাঘর পাশাপাশি না হওয়াই ভাল।” আর যদি পুরনো ফ্ল্যাট হয়, যেখানে সব কিছু বাস্তু মেনে তৈরি হয়নি, সেখানেও দরকার মতো বাস্তুসম্মত জিনিস রাখলে সমাধান সম্ভব। “তবে তার জন্য বাড়ির মালিকের কুষ্টি বিচার করা দরকার,” বলছেন আরেক বাস্তু কনসালট্যান্ট রাজীবকুমার সেখরি।
শ্রীভেঙ্কটেশ ফিল্মসের কর্ণধার শ্রীকান্ত মোহতা। বাস্তু মানেন প্রায় ১২ বছর। “এটা কোনও কুসংস্কার নয়। বিজ্ঞান,” বলছেন তিনি। তাঁর পুজোর ঘর উত্তর-পূর্বে। “পুবেই তো সূর্যের অবস্থান। সেই এনার্জি যাতে কিছুটা ধরতে পারি সেটাই লক্ষ্য” বলছেন তিনি। তাঁর বাড়ির গেটও বাস্তু মেনেই। উত্তর বা উত্তর পূর্ব-কোণে। মাস্টার বেডরুম বা অফিসের চেম্বার উত্তর-পশ্চিম দিকে। প্যাটন-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর সঞ্জয় বুধিয়া। বাড়ি বা ফ্যাক্টরি কিনতে গেলে তিনিও মাথায় রাখেন জমি যেন আয়তক্ষেত্র হয়। তাঁরও অফিস-চেম্বার আর বাড়ির মাস্টার বেডরুম দক্ষিণ-পশ্চিম দিকেই।
শ্রীকান্ত মোহতা আর সঞ্জয় বুধিয়াদের উল্টো দিকে আছেন গুগল ইন্ডিয়ার অন্যতম কান্ট্রি হেড পরমা রায়চৌধুরী। স্বামী-পুত্র-কেরিয়ার মিলিয়ে চূড়ান্ত সফল। তাঁর বক্তব্য, “বাস্তু-টাস্তু কিচ্ছু না। বাড়িটা সুন্দর কি না সেটাই আমার কাছে মোদ্দা কথা। আর সেটা কোনও বাস্তুকার তৈরি করেন না। করেন একজন আর্কিটেক্ট।”
এ সব ব্যাপারে সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ধাতটা আরও কড়া। তাঁর কথায়, “এর মধ্যে বিশ্বাস আছে। যুক্তি নেই। আমার বিশ্বাস নেই। তাই মানি না।”


বাস্তু বিতন্ডা
পক্ষে বিপক্ষে
এটা কোনও কুসংস্কার নয়। বিজ্ঞান।
শ্রীকান্ত মোহতা, কর্ণধার, শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস
এর মধ্যে যুক্তি নেই। তাই মানি না।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সাহিত্যিক।
বাস্তু কাকতালীয় হতে পারে না।
রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, অভিনেত্রী।
বাস্তু-টাস্তু কিচ্ছু না। বাড়িটা সুন্দর কি না
সেটাই আমার কাছে মোদ্দা কথা।
পরমা রায়চৌধুরী, অন্যতম কান্ট্রি হেড, গুগল ইন্ডিয়া।
বাস্তু মেনে জমি-বাড়ি কিনি।
সঞ্জয় বুধিয়া, শিল্পপতি।
আমার মনে হয় বাস্তু আসলে একটা এসকেপ রুট।
আদিত্যকুমার বাজোরিয়া, শিল্পপতি।

আরও আছে। শিল্পপতি এবং কান্ট্রি রোড-এর কর্ণধার আদিত্যকুমার বাজোরিয়া যেমন বাস্তুতে একেবারেই বিশ্বাসী নন। “আমি যে বাড়িতে থাকি সেটা বহু দিনের। হঠাৎ আমার সময় খারাপ যেতে শুরু করল। তার মানে কি আমার বাসস্থানে বাস্তু দোষ? হতে পারে না। খুঁজলে দেখা যাবে সমস্যাটা আসলে আমার কোনও ডিসিশনের জন্য হচ্ছে। বদলাতে হলে, সেই ডিসিশনটা বদলাতে হবে। আমার মনে হয় বাস্তু আসলে একটা এসকেপ রুট।” অথচ তাঁরই আছে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা। সেখানে ক্রেতাদের কাছ থেকে বাস্তুসিদ্ধ ফ্ল্যাটের অনুরোধ পান না?
“পাই তো। এবং সেটা রাখারও চেষ্টা করি। কারণ সেটা আমার ব্যবসা। তবে বিশ্বাস করুন, জীবনে কোনও ফ্ল্যাট একশো শতাংশ বাস্তুসিদ্ধ হতে পারে না। সেটা করা সম্ভবই না,” বলছেন তিনি।
এঁরা তো সেলিব্রিটি। চূড়ান্ত সফল। কিন্তু মহাশ্বেতা বসুর মতো স্কুলশিক্ষিকাও যে প্রায় একই কথা বলছেন। “বাস্তু করলে সুখ আসবে। বাস্তু করলে শান্তি এ সব শুনতে দারুণ লাগে। কিন্তু এ সব করার খরচটা কে জোগাবে?” বাস্তুবিতর্কে এমন অনেকে আছেন যাঁরা লাইনের ধারে বসে ম্যাচটা উপভোগ করতেই আনন্দ পান বেশি। যেমন অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। “শুনেছি বাস্তু মানলে সুখশান্তি আসে। আমার বাড়ি অবশ্য বাস্তু মেনে হয়নি। তাই এখনও জানি না এতে সত্যি কতটা ফল দেয়।”
অতিলৌকিক বাস্তু?
না অতিবাস্তব জীবন?
দ্য চয়েস ইজ ইওরস...


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.