স্টিমার চালানোই সহজ, রাজ্য নয়, মন্তব্য মমতার
চার্লি মাইক স্টিমার চালাচ্ছেন স্যর!
বুধবার দুপুরে হাতের ম্যানপ্যাক ওয়াকিটকি থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার পুলিশ সুপারকে বিহ্বল বার্তা পাঠালেন গোসাবা থানার এএসআই দীপক রুদ্র।
চার্লি মাইক। অর্থাৎ সিএম। অর্থাৎ চিফ মিনিস্টার। অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রী। অর্থাৎ কি না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
পাশে স্টিমারের ‘পাইলট’ যতীন্দ্রনাথ রফতান। ‘হুইল কেবিনে’র চার দিকে ডিজিটাল ক্যামেরার শাটার টেপার যান্ত্রিক শব্দ। এই প্রতীকী ছবি মিস করে কোন আহাম্মক! সঙ্গে নির্ভুল ক্যাপশন ‘রাজ্য চালনার স্টিয়ারিং যাঁর হাতে, তাঁর হাতে এখন স্টিমারের স্টিয়ারিং হুইল’।
শীতকালীন বিদ্যাধরী নদী। কোথাও সামান্য তরঙ্গও নেই। ফলে অত্যন্ত মসৃণ হল মমতার স্টিমার-চালনা। অনুসন্ধিৎসুদের জন্য বলে রাখা যাক, দেখতে বিভীষণ হলেও গাড়ির স্টিয়ারিংয়ের মতোই কাজ করে জলযানের স্টিয়ারিং হুইল। ডান দিকে যেতে চাইলে ডাইনে। বাঁয়ে যেতে চাইলে যথাবিহিত বাঁ-দিকে কাটাতে হয়। পাড়ে ভেড়ানোর সময় একটু কসরত করতে হয় অবশ্য। কিন্তু মমতা তো ঘণ্টাখানেক শুধু চালালেন। তীর তো বহু দূরে। তাঁর সামনে সুবিশাল জলরাশি। দু’পাশে কোথাও ম্যানগ্রোভের গহিন বন। কোথাও টুকরো জনপদ।
জলে ট্র্যাফিক জ্যামও নেই। আর স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী স্টিমার চালাচ্ছেন বলে কথা!
কাণ্ডারী... নতুন ভূমিকায়। স্টিমার চালাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। গোসাবায় বুধবার। ছবি: অশোক মজুমদার
বেলা ১১টা নাগাদ সজনেখালি থেকে রওনা হয়ে বিশাল নৌবহর নিয়ে মমতা ঘুরে বেড়ালেন (দাপিয়ে বেড়ালেন, বলাই ভাল) সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা। যে কারণে এই কপির ‘ডেটলাইন’ দেওয়া হল ‘সুন্দরবন’। কখনও সজনেখালিতে। কখনও পাখিরালয়ে। কখনও বাসন্তীতে ফিরতে ফিরতে আচমকা স্টিমারের মুখ ঘুরিয়ে মরিচঝাঁপির দিকে। কোনও এক জায়গায় থিতু হলে তো!
মঙ্গলবার তাঁর সরকারি কর্মসূচি ছিল গোসাবায়। কিন্তু এ দিন তো আর তেমন কিছু ছিল না। কথা ছিল, সজনেখালিতে রাত্রিবাস করে, সকালে একাধিক প্রশাসনিক বৈঠক সেরে তিনি রওনা হবেন প্রথমে জলপথ এবং পরে সড়কপথে কলকাতার দিকে। কিন্তু মমতা তো বেরিয়েছেন, তাঁর নিজের ভাষায়, সুন্দরবনের মানুষের সঙ্গে ‘ডিরেক্ট কনট্যাক্ট’ করতে।
অতএব, তাঁর প্রথম অ-নির্ধারিত বিরতি নদীর উল্টো দিকে পাখিরালয়ে। যেখানে তিনি খতিয়ে দেখলেন আয়লার পর বাঁধ নির্মাণের অগ্রগতি। বাঁধের উপরের ইট-বিছানো রাস্তা (মুখ্যমন্ত্রী আসতে পারেন ভেবে যে রাস্তা গত সোমবারই তৈরি করা হয়েছে) ধরে খর রোদে হাঁটলেন কয়েক কিলোমিটার। মমতা যেখানেই পৌঁছন না কেন, তাঁকে ঘিরে মুহূর্তে একটা কৌতূহলী জটলা তৈরি হয়। পাখিরালয়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। দলীয় তহবিল থেকে খরচা দিয়ে দরিদ্র মানুষের জন্য বেশ কিছু শীতবস্ত্র ও কম্বল নিয়ে গিয়েছিলেন মমতা। সেগুলো তো বিলি হলই, পাশাপাশি বাঁধের পাশের চায়ের দোকান থেকে প্রায় সমস্ত চিপ্সের প্যাকেট কিনে গ্রামবাসীদের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন মমতার সঙ্গী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায়, রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মণ্ডল, এলাকার বিধায়ক জয়ন্ত নস্কররা।
তাঁকে দেখে ভিড় করে-আসা মানুষের সঙ্গে জোড়হাত করে কথা বললেন মুখ্যমন্ত্রী। আসলে স্পষ্ট আবেদন করলেন, “আপনারা বাঁধ তৈরির জন্য জমি দিন। তাতে আপনাদেরই ভাল হবে। সিপিএম-আরএসপি এখানে রাজনীতি করছে। লোককে বোঝাচ্ছে, বাঁধের জন্য জমির ক্ষতিপূরণের চেক না-নিতে। ওদের কথা বিশ্বাস করবেন না। আমার উপর বিশ্বাস রাখুন। আমার আবেদন, সকলে মিলে বাঁধের জন্য জমি দিতে এগিয়ে আসুন।”
গত ২০০৯ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আয়লার পর এত দিন কেটে গেলেও বাঁধ পুনর্নির্মাণ সে ভাবে হয়নি জমির অভাবেই। পাঁচ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রের তরফে
বরাদ্দ হয়েও পড়ে রয়েছে। ফলে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতাকে আবেদন করতেই হবে। বস্তুত, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসা লোকজন মমতাকে বলেওছেন, “দিদি, দেখবেন বাঁধটা যেন হয়। নইলে আমরা মারা পড়ব।” মমতা তাঁদের পাল্টা বলেছেন, “সব হবে। কোনও চিন্তা করবেন না। এখানে উন্নয়ন হবে। আপনাদের সঙ্গে নিয়েই হবে। কিন্তু বাঁধটা হতে দিন। নইলে আপনারাই ভবিষ্যতে বিপদে পড়বেন।” তার পর স্টিমারে ফিরে আসতে আসতে বলেছেন, “আমি কিন্তু কোনও বাধা মানব না! সরকারকে মানুষের কাজে ব্যবহার করতে হবে। করতেই হবে!”
পাখিরালয় থেকেই মুখ্যমন্ত্রীর ফেরার কথা ছিল বাসন্তীর সোনাখালিতে। কিন্তু বিধায়ক জয়ন্তবাবুর কাছে যখন জানা গেল, মরিচঝাঁপি দ্বীপ খুব একটা দূরে নয়, তখন মমতা নির্দেশ দিলেন সেদিকে যেতে। ক্ষমতায় আসার পর বাম আমলের বহু ঘটনার মতো মরিচঝাঁপির ‘উদ্বাস্তু-নিপীড়ন ও হত্যা’ নিয়েও তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন মমতা। তাঁর কথায়, “বাম আমলে যে অসংখ্যা গণহত্যার ঘটনা ঘটেছিল, মরিচঝাঁপি থেকেই তার শুরু। তখন আমি সুব্রত’দার নেতৃত্বে এখানে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রশাসন থেকে আমাদের আটকে দেওয়া হয়েছিল। তাই এখন এলাম।” সুব্রতবাবুর কথায়, “পানীয় জল এবং খাবার বন্ধ করে যে নারকীয় অত্যাচার বাংলাদেশি উদ্বাস্তুদের উপর করা হয়েছিল এবং তার পর তাদের বিক্ষোভে গুলি চালানো হয়েছিল, তার নজির এই পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। অসংখ্য মানুষ নিহত হয়েছিলেন। উদ্বাস্তুদের সঙ্গেই মৃত্যু হয়েছিল সাধারণ মানুষেরও। মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এলাকা বলে ব্যাপারটা নিয়ে আন্দোলন দানা বাঁধেনি। গণমাধ্যমও এত শক্তিশালী ছিল না।” আর মুকুলবাবুর কথায়, “উদ্বাস্তুদের উপর এত বড় আক্রমণ কখনও হয়নি।” বস্তুত সুব্রতবাবু স্টিমারেই মুখ্যমন্ত্রীকে প্রস্তাব দেন, মরিচঝাঁপির ইতিহাস সংবলিত এক স্মৃতিসৌধ ওই দ্বীপে তৈরি করার। স্বভাবতই, মমতা আপত্তি করেননি।
মরিচঝাঁপি থেকে স্টিমার ঘুরিয়ে সোনাখালি এবং সেখান থেকে পূর্বনির্ধারিত রাস্তার বদলে ভাঙাচোরা রাস্তা ধরে উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালি, মিনাখাঁ হয়ে কলকাতায় ফেরা। যে সমস্ত রাস্তায় তাঁর গাড়ি থামিয়ে দিলেন কাতারে কাতারে মানুষ। জেলা প্রশাসন তটস্থ হচ্ছিল বিক্ষোভ হচ্ছে নাকি?
ত্রস্ত পুলিশকে ‘কাকু’ বলে ডেকে জনতা আকুতি জানিয়েছে, “গত ৩০ বছরে এলাকার এমএলএ-কেও একবার দেখিনি। এই প্রথম মুখ্যমন্ত্রী দেখছি! একটু দেখতে দিন না!” তা, জনতা দেখেছেও আশ মিটিয়ে। মুখ্যমন্ত্রী দাঁড়িয়েছেন। গাড়ি থেকে নেমেছেন। রাস্তার পাশের দোকান থেকে সিঙাড়া আর ঝুরিভাজা কিনে বিলিয়ে দিয়েছেন। তার পর আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতি দিয়ে রওনা হয়েছেন।
চলতে চলতেই কুৎসিত খানাখন্দে ভরা রাস্তা দেখে ক্রুদ্ধ মমতা যোগাযোগ করেছেন রাজ্যের মুখ্যসচিব সমর ঘোষ এবং তার পর পর্যায়ক্রমে জেলাশাসক ও পূর্তসচিবের সঙ্গে। নির্দেশ দিয়েছেন, “অবিলম্বে রাস্তা সারান! আমি আবার আসব এক মাস পরে!”
দেখতে দেখতে স্টিমারের স্টিয়ারিং হুইলের পিছনে মমতাকে মনে পড়ছিল। যিনি পাশে দাঁড়ানো হেঁটো ধুতি, পাঞ্জাবি আর রোঁয়া-ওঠা সোয়েটারের স্টিমারচালক যতীনবাবুকে (ঘটনাচক্রে বছর পঁচিশ আগে লড়ুয়ে মমতাকে এই স্টিমারচালকই লট নম্বর এইট থেকে কচুবেড়িয়া পৌঁছে দিয়েছিলেন। কৃতজ্ঞ মমতা তাঁকে মিষ্টি খাওয়ার জন্য যে সামান্য অর্থ দিয়েছিলেন, সেই নোটগুলো এখনও সযত্নে রেখে দিয়েছেন তিনি) দেখিয়ে বলছিলেন, “উনি আমাদের সহকর্মী। ফলে একটু সলিডারিটি জানাচ্ছি বলতে পারেন। যদি সামান্য হলেও ওঁদের পথের শরিক হওয়া যায়। আসলে আমি কো-পাইলট। ওঁর কাছে একটু শিখছি। শেখার একটা আগ্রহ আমার বরাবরই আছে। মনে হচ্ছে আমি চালাচ্ছি। আসলে কিন্তু শিখছি।”
কোনটা সোজা মনে হল? রাজ্য চালানো? না স্টিমার চালানো? বিন্দুমাত্র দ্বিধা না-করে আট মাসের প্রশাসক বললেন, “এটা এটা! স্টিমার চালানো। অনেক সোজা!”
সত্যিই। বাম আমলের ‘উত্তরাধিকার’ সূত্রে প্রাপ্ত দেউলিয়া রাজ্য, শিক্ষায়তনে অধ্যক্ষ-নিগ্রহ, কৃষক-মৃত্যু, তা নিয়ে জোটশরিক কংগ্রেসের খোঁচা, শিল্পবিমুখ ভাবমূর্তি পরিবর্তনের মরিয়া চেষ্টা, জনমোহিনী রাজনীতি করতে গিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভাড়া বা কর না-বসানোর নীতি, আয়লায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ পুনর্নির্মাণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথ যদি শীতের বিদ্যাধরীর মতো নিস্তরঙ্গ আর মসৃণ হত!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.