পুলিশে সংগঠন আগেই নিষিদ্ধ করেছে নতুন সরকার। এ বার সরকারি কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকারও তুলে নেওয়ার কথা ভাবছে তারা। মঙ্গলবার মহাকরণে রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু বলেন, “বামফ্রন্ট আমলে কর্মচারীদের ‘সার্ভিস রুল’ সংশোধন করে পুরোমাত্রায় ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার দেওয়া হয়েছিল। ওই বিধি ফের সংশোধন করে ‘ট্রেড ইউনিয়ন’ শব্দবন্ধনী বাদ দেওয়ার কথা ভাবছে সরকার।”
কেন এই সিদ্ধান্ত?
পূর্ণেন্দুবাবুর যুক্তি, নিয়মমতো সরকারি কর্মীরা ট্রেড ইউনিয়নের সব অধিকার ভোগ করতে পারেন না। অনুমতি ছাড়া তাঁরা কখনওই ধর্মঘট করতে, সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিতে বা মিটিং-মিছিল করতে পারেন না। কিন্তু ট্রেড ইউনিয়ন সদস্যদের সেই অধিকার দেওয়া আছে। বিধি মতে সরকারি কর্মীদের রাজনৈতিক দলের সদস্য হওয়া নিষিদ্ধ। কিন্তু তা কর্মী সংগঠনগুলি মানছে না বলে মন্তব্য করেন শ্রমমন্ত্রী। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “তৃণমূলের ট্রেড ইউনিয়ন আইএনটিটিইউসি-র স্বীকৃতি নিয়ে সরকারি কর্মী সংগঠন ‘ফেডারেশন অফ সেক্রেটারিয়েটস এমপ্লয়িজ’ তৈরি হয়েছে। তার মানে ওই সংগঠনের সদস্যরা তৃণমূল কংগ্রেসেরও সদস্য।” তাঁর হুঁশিয়ারি, “সরকারি কর্মীদের ট্রেড ইউনিয়ন করা চলবে না। ১৯৮১ সালে বাম সরকার কর্মীদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার দিয়েছিল। এটা বেআইনি কাজ।”
মহাকরণে মন্ত্রী বলেন, “কর্মচারীরা প্রয়োজনে তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে কনভেনশন ডাকতে পারেন। সেখানে আমরাও যেতে পারি। কিন্তু সরকারি কর্মচারীরা সরকারের বিরুদ্ধে মিছিল-মিটিং করবেন, এ আমি হতে দেব না। প্রয়োজনে ১৪৪ ধারা জারি করে তা ভেঙে দেব।”
এই মন্তব্য করে মন্ত্রী ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন তা নিয়ে এ দিন সারা দিনই মহাকরণে কর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। রাজ্য সরকার এ ভাবে ‘গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কণ্ঠরোধ’ করতে চাইছে কি না সেই প্রশ্নও উঠেছে। বিভিন্ন কর্মী ইউনিয়ন নিজেদের মতো করে বিবৃতিও দিতে শুরু করে।
পরে পূর্ণেন্দুবাবু তাঁর আগের মন্তব্য থেকে কিছুটা সরে এসে বলেন, “কর্মচারীদের মিছিল-মিটিং করার অধিকার কেড়ে নেওয়ার কথা আমি বলিনি। তবে ট্রেড ইউনিয়নের তকমা সরকার কখনওই দিতে পারে না। তাই বিধি থেকে ওই অংশটি তুলে দেওয়ার কথা বলেছি।”
মহাকরণের ক্ষমতা দখলের পরে একাধিক বার মুখ্যমন্ত্রী নিজে সরকারি কর্মচারীদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। কর্মচারী নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেই তিনি এক কিস্তি মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এই প্রথম কোনও মুখ্যমন্ত্রী কর্মী ইউনিয়নগুলির সঙ্গে বৈঠকে বসে কর্মী-সংক্রান্ত নানা সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সিপিএম প্রভাবিত কো-অর্ডিনেশন কমিটির নেতারাও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশংসা না করে পারেননি। কিন্তু রাজ্য সরকার পুলিশের পরে এ বার সরকারি কর্মীদের ‘ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার’ হরণ করতে চাওয়ায় অনেক কর্মচারী সংগঠনই আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে।
রাজ্য কো-অর্ডিনেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক অনন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বামফ্রন্ট সরকার আসার আগে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের ধর্মঘটের অধিকার ছিল না। সেই অধিকার দেওয়ার জন্যই বাকি নিয়মগুলি এক রেখে সরকারি কর্মীদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার দেয় জ্যোতি বসুর সরকার। এই অধিকার যদি কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়, তা হলে অতীতের মতো আবার আমরা আন্দোলনে নামব।”
কংগ্রেস-প্রভাবিত ফেডারেশন অফ স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের নেতা শ্যামলকুমার মিত্র ও সঙ্কেত চক্রবর্তীও প্রায় একই সুরে বলেন, “মাত্র আট মাসের মধ্যেই এই সরকার শ্রমিক-কর্মচারীদের ভয় পাচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত একেবারেই মানি না। প্রয়োজনে ধর্মঘট করেই এর প্রতিবাদ করব।” একই সঙ্গে তাঁদের দাবি, “২৮ ফেব্রুয়ারির সাধারণ ধর্মঘটকে ভয় পাচ্ছে সরকার। তাই এ ভাবে হুমকি দেওয়ার চেষ্টা করছে।”
বিরোধিতায় সরব হয়েছে ওয়েস্ট বেঙ্গল রাজ্য সরকারি কর্মচারী ফেডারেশন (নব পর্যায়)-এর সাধারণ সম্পাদক সমীররঞ্জন মজুমদারও। তাঁর কথায়, “সরকারি কর্মীরা সংগঠন করার অধিকার অর্জন করেছেন। কারও দয়ায় তা পাননি। ১৯৮১ সালেই রাজ্য সরকার লিখিত ভাবে জানিয়েছিল, এ রাজ্যে সরকারি কর্মীদের কোনও সংগঠন করতে গেলে সরকারি অনুমতির প্রয়োজন নেই। জরুরি অবস্থার সময়েও কর্মীদের সংগঠন করার অধিকার হরণ করা হয়নি।” তাঁর প্রশ্ন, “এমন কী অবস্থা এখন হল, যাতে সরকার এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভাবছে?”
তৃণমূলের কর্মী সংগঠন ফেডারেশন অফ সেক্রেটারিয়েটস-এর নেতা সঞ্জীব পাল অবশ্য বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী তিন মাস অন্তর কর্মচারী সংগঠনগুলির নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন। তাদের দাবি-দাওয়া শুনছেন। যুক্তিগ্রাহ্য দাবি হলে তা মেনেও নিচ্ছেন। তা হলে আর শুধু শুধু আন্দোলন করার দরকারটা কী।”সরকারি কর্মচারীদের দাবি দাওয়ার জন্য মিছিল করা নিষিদ্ধ হলে মিছিল করেই তাঁরা তার প্রতিবাদ করবেন বলে জানিয়ে রেখেছেন বিভিন্ন কর্মী ইউনিয়নের নেতারা। আর শুধু মহাকরণ নয়, সেই মিছিল হবে রাজ্যের সব সরকারি দফতরেই। |