পড়শি বালিকাকে হত্যার দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হল এক দম্পতির। মঙ্গলবার মলয় ঘোষ ও তাঁর স্ত্রী প্রিয়া ঘোষকে ওই সাজা শোনান পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর আদালতের ফাস্ট ট্র্যাক ফোর্থ কোর্টের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক অরূপ বসু।
রঘুনাথপুর শহরকে নাড়িয়ে দেওয়া এই খুনের ঘটনার সাত মাসের মধ্যেই বিচারপর্ব ও রায়দান হয়েছে। ২৪ জন সাক্ষী থাকা সত্ত্বেও মাত্র সাত মাসের মধ্যে রায়দান সম্পন্ন হওয়ার ঘটনাকে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলেই এ দিন জানিয়েছেন সরকারি আইনজীবী পঙ্কজ গোস্বামী। এবং নির্দিষ্ট সময়ের আগেই পুলিশের চার্জশিট দেওয়া ও সময়মতো সাক্ষীদের উপস্থিতির জন্য বিচারপর্ব দ্রুত সম্পন্ন হয়েছে। পঙ্কজবাবু বলেন, “ওই ঘটনায় পুলিশের সক্রিয়তা এবং এলাকার বাসিন্দাদের সহযোগিতার জন্যই দ্রুত বিচারপর্ব সম্পন্ন হয়েছে।” সাক্ষীদের মধ্যে ছিল আট বছরের স্কুলছাত্রীও।
|
তমালিকা। |
সরকারি আইনজীবী জানান, ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ (খুন) ধারা অনুযায়ী ওই দম্পতিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা (অনাদায়ে আরও এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড) করার পাশাপাশি ২০১/৩৪ (প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা) ধারা অনুযায়ী সাত বছর কারাদণ্ড ও ২ হাজার টাকা করে জরিমানার (অনাদায়ে আরও ৬ মাস জেল) নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। দু’টি সাজাই একসঙ্গে চলবে। পুলিশ সূত্রের খবর, গত বছর ২১ জুলাই থেকে নিখোঁজ ছিল রঘুনাথপুরের ব্লকডাঙা এলাকার বাসিন্দা মথুর দেওঘরিয়ার ছ’বছরের মেয়ে তমালিকা। পরদিন সকালে প্রতিবেশী দম্পতি মলয় ও প্রিয়ার বাড়ির আলমারি থেকে ব্যাগবন্দি অবস্থায় প্রথম শ্রেণির ছাত্রী তমালিকার দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। হাত-পা-হাঁটু মুড়ে জোর করে তমালিকার দেহ ঢোকানো হয়েছিল ওই ব্যাগে। সেই দৃশ্য দেখে মলয় ঘোষকে বেধড়ক মারধর করেন এলাকাবাসী। ওই বালিকার দেহ উদ্ধার করতে গিয়ে জনরোষে শিকার হয় পুলিশও। |
এলাকাবাসীর মারে আহত হন রঘুনাথপুরের এসডিপিও এবং তৎকালীন সিআই। শূন্যে গুলি চালিয়ে পুলিশকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়েছিল। মর্মান্তিক ওই খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত দম্পতির কঠোর সাজার দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন রঘুনাথপুর শহরের বাসিন্দারা। হয়েছিল মোমবাতি মিছিল। পুলিশও প্রথম থেকেই ঘটনার কিনারা করতে সচেষ্ট ছিল। রঘুনাথপুর থানার এক সাব-ইনস্পেক্টর ছাড়াও তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল রঘুনাথপুরের বর্তমান সিআই প্রিয়ব্রত বক্সীকে। এসডিপিও দ্যুতিমান ভট্টাচার্য বলেন, “আমরা প্রথম থেকেই এই মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করতে উদ্যোগী হয়েছিলাম। প্রিয়ব্রত বক্সী-সহ গোটা তদন্তকারী দলই খুব ভাল কাজ করেছে।”
ঘটনা হল, ওই দম্পতিকে গ্রেফতারের ৯০ দিনের মধ্যেই পুলিশ আদালতে চার্জশিট জমা দেওয়ার ফলে জেল থেকে কখনওই ছাড়া পায়নি বেসরকারি বিমা সংস্থার কর্মী মলয় ও তাঁর স্ত্রী প্রিয়া। গোটা বিচারপর্বই সম্পন্ন হয়েছে দম্পতি জেলবন্দি থাকা অবস্থায়। গত বছর ৯ ডিসেম্বর থেকে রঘুনাথপুর আদালতের ফাস্ট ট্র্যাক ফোর্থ কোর্টে বিচারক অরূপ বসুর এজলাসে এই হত্যা-মামলার শুনানি শুরু হয়েছিল। মোট সাক্ষী ছিলেন ২৪ জন। সোমবারই বিচারক ওই দম্পতিকে দোষী সাব্যস্ত করেন। এ দিন সেই মামলার রায় শুনতে আদালত চত্বর ছিল ভিড়ে ঠাসা। মলয়ের পরিবারের কেউ হাজির না থাকলেও প্রিয়ার বাড়ির লোকেরা ছিলেন। ছিলেন নিহত স্কুলছাত্রীর বাবা মথুর দেওঘরিয়া, তাঁর আত্মীয়স্বজন এবং এলাকার বহু বাসিন্দা। রায়দানের আগে মথুরবাবু বলেন, “আমার স্ত্রী মিতালি এখনও মেয়ের অকাল মৃত্যুর শোক ভুলতে পারেনি। তাই এ দিন ওকে আদালতে আনিনি।” |
ভিড়ে ঠাসা এজলাসে বিচারক রায় দেওয়ার সময় জানান, সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে মলয় ও প্রিয়া, দু’জনের বিরুদ্ধেই অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। দু’জনই সমান অপরাধী এবং দু’জনের উদ্দেশ্যই এক ছিল। সরকারি আইনজীবী পঙ্কজবাবু জানিয়েছেন, ২১ জুলাই সন্ধ্যায় বাড়িতে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ার পরে তমালিকা ওর মাকে বলেছিল, সে মলয়ের বাড়িতে যাচ্ছে। মলয়দের বাড়িতে থাকা অ্যাকোয়ারিয়াম, পুতুল, কম্পিউটার দেখার জন্য আগেও বহুবার ওদের বাড়িতে গিয়েছিল তমালিকা। পঙ্কজবাবু বলেন, “তমালিকাকে মলয়দের বাড়িতে ঢুকতে দেখেছিল আট বছরের একটি ছোট মেয়ে। সাক্ষীদের মধ্যে ওই মেয়েটিও ছিল।”
সাক্ষ্য দিতে এসে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক অমল নাথও আদালতকে জানিয়েছিলেন, তমালিকাকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে। পঙ্কজবাবুর কথায়, “বিচারকের কাছে গোপন জবানবন্দিতে প্রিয়া ঘোষ আগেই জানিয়েছিল, ঋণ নিয়ে কেনা গাড়ির কিস্তির টাকা শোধ করার জন্য তমালিকাকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের ছক কষেছিল মলয়।” এই বিষয়টিকেই খুনের কারণ হিসাবে শুনানিতে জানিয়েছিলেন সরকারি আইনজীবী।
বিচার দ্রুত শেষ হওয়ায় সন্তুষ্ট মথুরবাবু ও তাঁর পরিবারও। এ দিন আদালত চত্বরে দাঁড়িয়ে মথুরবাবু বলেন, “আমরা চেয়েছিলাম, দু’জনের মধ্যে এক জনের চরম সাজা হোক। তবে এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ট।” একই সঙ্গে তাঁর আক্ষেপ, “ওদের যাবজ্জীবন হল। কিন্তু আমার মেয়েকে তো আর ফিরে পাব না! তাই চরম সাজা চেয়েছিলাম।” সাজাপ্রাপ্ত প্রিয়ার পরিবারের কেউই মন্তব্য করতে চাননি। ওই দম্পতির আইনজীবী তপন মাজি জানান, এই রায়ের বিরুদ্ধে প্রিয়ার পরিবার উচ্চ আদালতে যাবে বলে তাঁকে জানিয়েছে।
|