সুন্দরবনের ভোল পাল্টাতে টাস্ক ফোর্স, উন্নয়নের আশ্বাসে ‘কল্পতরু’ মমতা
কৃষকদের বার্তা দিয়ে শুরু ‘দুর্গ’রক্ষার যুদ্ধ
প্রথমত, কৃষকরা নিজেরা ঋণ নিন। চাষ করুন। ঋণ শোধ করুন। শোধ করলে আবার ঋণ পাবেন।
দ্বিতীয়ত, অবশ্যই শস্যবিমা করান। তার প্রিমিয়ামের টাকা সরকার দেবে। কিন্তু শস্যবিমা করাতেই হবে। পাঁচ দিন ঘোরাঘুরি করতে হলেও। বিডিও সাহায্য না-করলে স্থানীয় বিধায়ককে বলুন।
তৃতীয়ত, কিষাণ ক্রেডিট-কার্ড করান।
রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় কৃষক-মৃত্যু (মতান্তরে, কৃষক-আত্মহত্যা) নিয়ে বিরোধীদের নিরন্তর সমালোচনার মুখে এ বার কৃষকদের সরাসরি ‘পরামর্শ’ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার সুন্দরবনের যে প্রত্যন্ত প্রান্ত গোসাবায় এক সরকারি অনুষ্ঠান থেকে মুখ্যমন্ত্রী ওই ‘বার্তা’ দিলেন, জঙ্গল এবং নদী-অধ্যুষিত সেই এলাকায় এখনও পর্যন্ত কোনও কৃষকের অপঘাত-মৃত্যুর খবর নেই। বরং এখানে মমতা এসেছেন মানুষের সঙ্গে ‘প্রত্যক্ষ যোগাযোগের’ তাগিদে। সরকারি কর্মসূচির মাধ্যমে এলাকায় উন্নয়নের ‘কর্মযজ্ঞ’ শুরু করতে। কিন্তু সেই মঞ্চ থেকেও তাঁর কৃষকদের প্রতি এই ‘বার্তা’ তাৎপর্যপূর্ণ। যা বলছে, মুখ্যমন্ত্রীকে ভাবাচ্ছে কৃষক-মৃত্যু।
বাকি তিনি সুন্দরবনের জন্য ‘কল্পতরু’।
খোশমেজাজে মুখ্যমন্ত্রী। গোসাবা থেকে সজনেখালি যাওয়ার পথে। মঙ্গলবার বিকেলে। ছবি: অশোক মজুমদার।
সড়ক এবং নদীপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার সার্বিক উন্নতি, গ্রামীণ বিদ্যুদয়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ, আয়লায় গৃহহীনদের জন্য প্রকল্প, গৃহহীন দুর্গতদের জন্য সহায়তা-প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অর্থ দেওয়া, ১৫ হাজার পরিবারকে আগামী ছ’মাস ধরে সপ্তাহে দু’কেজি করে চাল বণ্টন, সাড়ে ৪০০ গভীর নলকূপ বসানোর ব্যবস্থা, গোসাবায় গার্লস স্কুলের প্রতিশ্রুতি, সম্প্রতি বাংলাদেশের জলদস্যুদের হাতে নিহত মৎস্যজীবীদের পরিবারকে দু’লক্ষ টাকা করে সাহায্য, ওই ঘটনায় গুরুতর আহত এবং অল্প আহতদের জন্য যথাক্রমে ৫০ হাজার এবং ২৫ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ, পর্যটনের পরিকাঠামো উন্নয়ন (এই সফরে দিল্লির যোজনা কমিশনের অনুমোদিত একটি পর্যবেক্ষক দল এবং সিআইআই-এর প্রতিনিধি দলও নিয়ে এসেছেন মমতা। যাদের সঙ্গে রাতেই রাজ্য প্রশাসনকে নিয়ে বৈঠক করে একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করলেন তিনি। সময়সীমা এক মাস। যার মধ্যে সুন্দরবনের ভোল পাল্টানোর ব্যাপারে রিপোর্ট দিতে হবে মুখ্যসচিবকে) কী নেই!
অনুষ্ঠানের শেষে রসিকতা করে বলা গেল, ঘরে ঘরে বাঘ পোষা ছাড়া সুন্দরবনের মানুষের জন্য প্রায় সব কিছুতেই অর্থ বরাদ্দ করে দিল তাঁর সরকার!
একটুও না-হেসে অত্যন্ত সিরিয়াস গলায় মুখ্যমন্ত্রী বললেন, “এঁরা অত্যন্ত গরিব মানুষ। যদি কিছু সাহায্য করা যায় তো খারাপ কী?” সঙ্গে সংযোজন, “প্রত্যন্ত এলাকার এই গরিব মানুষেরা জলে কুমির-ডাঙায় বাঘের সঙ্গে লড়ে বেঁচে আছেন। আমি তাঁদের জীবনটা অন্য রকম করতে চাই। আমি চাই, সুন্দরবন প্রকৃত অর্থে সুন্দর হোক।”
বস্তুত, দু’দিনের সুন্দরবন সফরে (গোসাবা থেকে জলপথে সজনেখালি পৌঁছে সেখানেই এ দিন রাত্রিবাস করেছেন তিনি। জলপথে নিজের মোবাইলে শিশুসুলভ চাপল্যে ছবি তুলেছেন জল-জঙ্গলের। আজ, বুধবার আরও কিছু এলাকা জলপথে টহল দিয়ে রাতে ফেরার কথা কলকাতায়) মুখ্যমন্ত্রী এসেছেন, তাঁর নিজের কথাতেই, “দু’টি লক্ষ্য নিয়ে। এক, নিজের চোখে জায়গাগুলো দেখা। যার মূল আয়লার পর পুনর্গঠনের কাজ কতটা হয়েছে। দুই, পর্যটনের বিকাশের জন্য জায়গা বাছা। সম্ভবত বিশ্বব্যাঙ্ক এতে সাহায্যও করবে।” সরকারি অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে বলেছেন, “অনেকে এখানে এসে বাঘ আর কুমির দেখে পালিয়ে গিয়েছেন। মানুষ দেখেননি। আমরা মানুষকে দেখতে এসেছি।”
গত চৌত্রিশ বছরের বাম শাসনে দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সুন্দরবনে যে একেবারেই আসেননি, তা নয়। কিন্তু অধুনা শাসক শিবির বলছে, “ওঁরা সাড়ে তিন দশকে ক’বার এসেছিলেন? আর আমাদের মুখ্যমন্ত্রী ক্ষমতায় আসার মাত্র আট মাসের মাথায় এলেন! সেই তুলনাটা কি মানুষ করবেন না?”
হয়তো করবেন। হয়তো করবেন না। কিন্তু বাম জমানার চেয়ে তো এই অ-বাম জমানার মুখ্যমন্ত্রীর কাজের স্টাইল অনেক আলাদা! দ্রাবিড়োচিত ধ্রুপদী ব্যাটিং নয়। সহবাগ-সুলভ ঝোড়ো ইনিংস। পা-কাঁধ-মাথা বলের লাইনে গেল কি না-গেল, কে দেখে! রান এলেই হল! আর ১৮৫টি আসন নিয়ে এ রাজ্য তো আপাতত মমতার কাছে ‘পাটা উইকেট’। যেখানে তিনি বিছিয়ে দিচ্ছেন নিজস্ব স্টাইলের জনসংযোগ। আর হাততালির ঝড়ের মধ্যে বলছেন, “আমাদের সরকার গর্বের সরকার। কুৎসা করে এই সরকারের ক্ষতি করা যাবে না।”
কলকাতা থেকে সড়কপথে বাসন্তীর সোনাখালি হয়ে লঞ্চে গোসাবা নামক সুন্দরবনের প্রত্যন্ত ভূখণ্ডে এসে পৌঁছন মুখ্যমন্ত্রী। কাকতালীয় ভাবে, সে লঞ্চের নাম ‘আগমনী’।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার যে বিস্তীর্ণ এলাকা তিনি গাড়িতে পেরিয়ে এলেন, সেই রাস্তার দু’ধারে মানুষের থিকথিকে ভিড়। হাতে তৃণমূলের ঝান্ডা। ফুলের তোড়া। পুষ্পবৃষ্টি। স্বাভাবিক। ২০০৮ সালে যে পঞ্চায়েত ভোট দিয়ে রাজ্যে মমতার ‘রাজনৈতিক পুনরুত্থানের’ শুরু, সেই ভোটে পূর্ব মেদিনীপুরের সঙ্গে এই দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পরিষদও অধিকার করেছিলেন মমতা। সে দিক দিয়ে দেখতে গেলে তাঁর রাজ্য দখলের সোপান শুরু এই জেলা থেকেই। এই জেলাতেই তিনি প্রথম ‘বিরোধী’ থেকে ‘শাসকের’ভূমিকায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। যা অব্যাহত থেকেছে গত বিধানসভা ভোট পর্যন্ত।
এ দিন কুলতলি নামক এসইউসি-অধিকৃত ভূখণ্ডেও তাঁর দিকে বন্যার জলের মতো জনস্রোত ধেয়ে এসেছে। বারুইপুরে লেভেল ক্রসিং পেরোনোর সময় উড়ে এসেছে মন্তব্য, “এমন মুখ্যমন্ত্রী আর হবে না। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী!” সোনাখালি থেকে গোসাবা পর্যন্ত তাঁর কনভয় (মোট ১৬টি লঞ্চ। সামনে জেলা পুলিশের স্পিডবোট। নদীপথের ‘পাইলট কার’) যে পথ এক ঘণ্টার কিছু বেশি সময় ধরে অতিক্রম করল, সেখানেও নদীর দু’পাশে মানুষের জটলা। রাস্তায় থাকলে এ সব সময়ে মমতা গাড়ি থামিয়ে সটান নেমে পড়েন। নদীতে তার উপায় ছিল না। ফলে মুখ্যমন্ত্রী লঞ্চের কিনারায় গিয়েই প্রবল বেগে হাত নেড়েছেন। কখনও সঙ্গী মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, “পাঠানখালি কলেজের মাঠে বছরে দু’বার সভা করতে আসতাম মনে আছে? তখন বাঁধের উপর দিয়ে প্রায় চার-পাঁচ কিলোমিটার পথ হাঁটতে হত!” মমতা জানিয়েছেন, তাঁর মনে আছে। জনতাকে জানিয়েছেন, তিনি আবার আসবেন কাজের অগ্রগতি দেখতে। সামনে-বসা দীনদরিদ্র মানুষকে একাত্ম করতে বলেছেন, “আমরাও শ্রমজীবী মানুষ। গায়ে-গতরে খেটে খাই।”
সোনাখালির লঞ্চঘাটে মুখ্যমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে ফুলের তোড়া নিয়ে হাজির ছিলেন বাসন্তীর আরএসপি বিধায়ক তথা রাজ্য বিধানসভার সহকারী বিরোধী নেতা সুভাষ নস্কর। মমতা তাঁকে দেখে ঈষৎ অবাকই হয়েছেন। ফুল হাতে নিয়ে কুশল প্রশ্ন করেছেন। সুভাষবাবুর অনুযোগ ছিল। যা পরে জানা গেল, “মুখ্যমন্ত্রীকে একটা কথা বলতে চেয়েছিলাম। সুন্দরবনের অন্তর্গত একটা এলাকা থেকে সাত বার বিধায়ক হয়েছি। আগে সুন্দরবন উন্নয়ন পরিষদের সদস্য ছিলাম। পরিষদের তহবিল থেকে উন্নয়নের কাজ করার জন্য বিধায়করা স্কিম দিতে পারেন। কিন্তু এ বার আমার কোনও স্কিম গ্রহণ করা হয়নি।” দ্রুত লঞ্চে অপসৃয়মাণ মুখ্যমন্ত্রীকে তা বলার সুযোগ পাননি প্রাক্তন মন্ত্রী সুভাষবাবু।
তবে সুব্রতবাবু, সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী শ্যামল মণ্ডল, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায়, জেলা পরিষদের সভাধিপতি শামিমা শেখের সঙ্গে দ্রুত লঞ্চে উঠেই মুখ্যমন্ত্রী উন্নয়নের বৈঠক শুরু করেছেন শ্যামলবাবু এবং শামিমার সঙ্গে। প্রশ্ন করেছেন, “কী চাই?” রাস্তা, পানীয় জল, সেতুর চাহিদার কথা জেনে লঞ্চ থেকেই ফোনে যোগাযোগ করেছেন রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরের সচিবের সঙ্গে। প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি গৌতম সান্যালকে নির্দেশ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় ভূতল পরিবহণ মন্ত্রী, কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রীদের জলদি চিঠি লিখতে। গোসাবার বিডিও অফিসের মাঠে ‘মুখ্যমন্ত্রী দেখতে’ জড়ো হয়েছিলেন কাতারে কাতারে মানুষ। এঁরা সকলেই গোসাবা দ্বীপের বাসিন্দা বলে জানালেন জেলা তথ্য দফতরের অফিসারেরা। তাঁদের মমতা দিয়েছেনও ঢেলে। তফশিলি উপজাতি ভুক্ত স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে ঋণ, প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের ভাতা, স্থানীয় ক্লাব-সংগঠনকে অর্থ বরাদ্দ তো ছিলই। ‘টানাটানির সংসারে’ মমতা ক্লাবগুলোকে অর্থ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে। বলেছেন, “টাকার পরিমাণ হয়তো সামান্য। কিন্তু তাদের আমরা সাহায্য করেছি ভালবাসার ছোঁয়া দিয়ে।” প্রতিটি জেলা সফরের মতোই এ বারেও মুখ্যসচিব সমর ঘোষ, স্বরাষ্ট্রসচিব জ্ঞানদত্ত গৌতম-সহ বিভিন্ন দফতরের সচিবকে নিয়ে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। যার ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছেন, “অন্য জেলায় মিনি মহাকরণ নিয়ে যাই। এ বার প্রায় আস্ত মহাকরণই তুলে এনেছি!” উপায় নেই। জনতার প্রত্যাশাকে যে পর্দায় বেঁধেছেন মমতা, তাতে লোকে তাঁর কাছে অহরহ সেঞ্চুরি চায়। পঞ্চায়েত ভোট আসছে। সুন্দরবনের ধাত্রী দক্ষিণ ২৪ পরগনার ‘দুর্গ’ রক্ষা করতে হবে স্বঘোষিত ‘বাঘের বাচ্চা’ মমতাকে। সম্ভবত যাঁর কানে বাজছে প্রত্যাশার চাপের ‘বিধিসম্মত সতর্কীকরণ’, “এমন মুখ্যমন্ত্রী আর হবে না। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী!”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.