মূল্যস্ফীতি আপাতত নিয়ন্ত্রণে আসিয়াছে। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার চার সপ্তাহ ধরিয়া শূন্যের নীচে রহিয়াছে, অর্থাৎ গত বৎসরের তুলনায় এই বৎসরে খাদ্যপণ্যের দাম কমিয়াছে। সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির হারও সাড়ে সাত শতাংশের কাছাকাছি। সাম্প্রতিক ভারত যে বিপুল মূল্যস্ফীতি প্রত্যক্ষ করিয়াছে, তাহাতে বর্তমান অবস্থাটিকে অলীক বোধ করা বুঝি আশ্চর্যের নহে। এই অবস্থায় স্বভাবতই সকলে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দিকে চাহিয়াছিল। মূল্যস্ফীতির হারে লাগাম পরাইবার জন্য ব্যাঙ্ক যখন কঠোর আর্থিক নীতির পথে হাঁটিয়াছিল, তখন মূল্যস্ফীতির নিম্নগামী হারে ব্যাঙ্কও কি নীতি শিথিল করিবে না? বিশেষত যখন ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধির হার ক্রমে শ্লথ হইয়া পড়িতেছে। ব্যাঙ্ক সম্পূর্ণ হতাশ করে নাই, কিন্তু বাজারের প্রত্যাশা অক্ষরে অক্ষরে পূরণও করে নাই। ব্যাঙ্ক যে হারটির মাধ্যমে বাজারের সুদের হারের ওঠানামার ইঙ্গিত দেয়, সেই রেপো রেট আট শতাংশ হারেই অপরিবর্তিত রহিল। কিন্তু, বহু দিন পরে ব্যাঙ্ক ক্যাশ রিজার্ভ রেশিয়ো কমাইল। ব্যবস্থাটি লইয়া দ্বিধার অবকাশ নাই। ক্যাশ রিজার্ভ রেশিয়ো কমায় বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির হাতে নগদ টাকার পরিমাণ বাড়িবে, ফলে বাজারে টাকার জোগানও বাড়িবে। ফলে, যে দমবন্ধ পরিবেশ তৈরি হইয়াছে, তাহা অংশত হইলেও শিথিল হইবে। কিন্তু, ব্যাঙ্ক বুঝাইয়া দিল, আর্থিক নীতি বিষয়ে অবস্থান এখনও বদলায় নাই। এই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টামণ্ডলীর চেয়ারম্যান সি রঙ্গরাজনের মন্তব্যটি উল্লেখ্য। তিনি বলিয়াছেন, খাদ্য ব্যতীত অন্যান্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার যত ক্ষণ না নিয়ন্ত্রণে আসিতেছে, তত ক্ষণ পথ পরিবর্তনের প্রশ্ন নাই। স্পষ্টতই, ব্যাঙ্কও একই কথা মনে করে। ফলে, সুদের হার অপরিবর্তিত থাকিল। সিদ্ধান্তটি ইঙ্গিতবাহী ব্যাঙ্কের নিকট এখনও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই প্রথম লক্ষ্য।
ব্যাঙ্কের সিদ্ধান্তটি ভিত্তিহীন নহে। আপাতত মূল্যস্ফীতির হার নিম্নগামী বটে, কিন্তু তাহা অকারণে নহে। প্রথম কারণটির নাম, পরিভাষায়, ‘হাই বেস এফেক্ট’। গত বৎসর এই সময় মূল্যস্তর এমনই চড়া ছিল যে তাহার সাপেক্ষে বর্তমান মূল্যস্তরকে তুচ্ছ বোধ হইতেছে। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক বাজারের পরিস্থিতি বিশেষ বদলায় নাই, বরং পেট্রোলিয়াম লইয়া জটিলতা বাড়িতেছে। ফলে, অদূর ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতির হার ফের মাথাচাড়া দিয়া উঠিবে, এমন আশঙ্কা অমূলক নহে। ব্যাঙ্ক স্বভাবতই ঝুঁকি লইতে রাজি হয় নাই। প্রশ্ন হইল, ব্যাঙ্ক এই দফায় যতটুকু করিয়াছে, তাহাতে ভারতের সমস্যা মিটিবে কি? বৃদ্ধির হারের গতিভঙ্গের সমস্যা, অবশ্যই। গত বাজেট হইতে আসন্ন বাজেটের মধ্যবর্তী সময়কালে বর্তমান অর্থবর্ষে ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধির হার বিষয়ক পূর্বাভাস ক্রমেই রক্ষণশীল হইতেছে। প্রায় নয় শতাংশ হইতে যে আলোচনার সূচনা, এখন তাহা সাত শতাংশের কাছাকাছি ঠেকিয়াছে। সম্প্রতি তৃতীয় ত্রৈমাসিকের আর্থিক ফল প্রকাশিত হইয়াছে। তাহাতেও গতিভঙ্গের চিত্রাভাস স্পষ্ট। ফলে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বর্তমান সিদ্ধান্ত লইয়া শিল্পমহলে কিঞ্চিৎ অসম্তোষ তৈরি হইয়াছে। ব্যাঙ্কের দুইটি কথা স্মরণে রাখা প্রয়োজন। এক, আর্থিক বৃদ্ধির হার বজায় রাখিবার দায়িত্বের কিয়দংশ তাহারও বটে। দুই, সেই দায় যাহার সর্বাধিক, সেই কেন্দ্রীয় সরকার আপাতত পক্ষাঘাতগ্রস্ত। ফলে, কোনও দায়িত্ব পালনেই সরকারের সক্রিয় ভূমিকার আশা না করা ভাল। এই পরিস্থিতিতে ব্যাঙ্কের উপর বাড়তি দায়িত্ব আসিয়া পড়ে। বর্তমান আর্থিক নীতির মাধ্যমে সেই দায়িত্ব সম্পূর্ণ পালন করা যাইবে কি না, দুব্বুরি সুব্বারাওকে তাহা ভাবিয়া দেখিতে হইবে। |