মা-ছেলের খুনসুটি দিয়ে শেষ হল সাহিত্য উৎসব
পুরনো ড্রাইভারের নামটা মনে পড়ছে না লীলা শেঠের। ড্রাইভারদের আড্ডায় তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, যে বাড়ির গাড়ি চালাও, তারা লোক কেমন? “লোক ভালই। তবে বড় ছেলেটা কিছু করে না, দোতলার জানলা থেকে হাঁ করে আকাশ দেখে। আর এক ছেলে বাগানে গাছপালা লাগায়। মেয়েটাও তেমনই। রাত ১১টায় ফেরে, তার পর সারাক্ষণ ফোন।” পাশ থেকে লীলাকে সেই ড্রাইভারের নাম মনে করিয়ে দিলেন ‘হাঁ করে আকাশ-দেখা’ সেই বড় ছেলে। সত্য সিংহ! এ দেশের হাইকোর্টে (হিমাচল প্রদেশ হাইকোর্ট) প্রথম মহিলা প্রধান বিচারপতি লীলা শেঠ এবং তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র বিক্রম শেঠ এই ভাবেই জমিয়ে দিলেন সাহিত্য উৎসবের শেষ দিনের অধিবেশন।
বড় ছেলের পরিচয় না হয় জানা গেল! বাগান-করা মেজ ছেলে? বৌদ্ধ শিক্ষাগুরু ও ধর্মাচার্য শান্তম শেঠ। আর রাত ১১টায় ফেরা মেয়ে? পরিচালক এবং ফোটোগ্রাফার আরাধনা শেঠ।
ছেলেমেয়েরা এ রকম খামখেয়ালি দেখেও আটকানোর চেষ্টা করলেন না? তাঁর বাঙালি বান্ধবী কল্যাণী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বলছিলেন লীলা। গর্ভাবস্থায় কল্যাণীই তাঁকে ‘শেষের কবিতা’ পড়ে শুনিয়েছিলেন। পরে আরও একটা কথা বলেছিলেন। পাখিকে যদি হাত মেলে ধরে চেটোয় রাখ, সে উড়ে যাবে। কিন্তু ফিরে আসবে। আর চেটো গুটিয়ে যদি মুঠোর মধ্যে রাখ, সুযোগ পেলেই চিরতরে উড়ে যাবে। আর ফিরবে না। “কথাটা আজও ভুলিনি,” বললেন লীলা।
লীলা শেঠ বাংলা পড়তে বা লিখতে পারেন না। কিন্তু অক্লেশে বুঝতে পারেন, বলতেও পারেন। বাবা ‘ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে’র ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। ফলে কলকাতা, দার্জিলিং, পাকসি (এখন বাংলাদেশে) নানা জায়গায় থেকেছেন লীলা। বিয়ের পর বেশ কয়েক বছর বাটানগরে। তার আগে ছেলেবেলায় দার্জিলিঙের লোরেটো কনভেন্ট। সেখানে তাঁর মা-বাবার বন্ধু ‘দত্ত পরিবার’ তাঁর স্থানীয় অভিভাবক। পরিবারের গৃহিণী জগদীশচন্দ্র বসুর ভাইঝি। তাঁর আত্মজীবনী ‘অন ব্যালান্স’-এ দার্জিলিঙে প্রৌঢ় জগদীশচন্দ্র বসুর কথা লিখেছেন লীলা। “বস্তুগত জীবনে নয়, অমরত্ব থাকে তোমার চিন্তায় আর আদর্শে,” বলতেন তিনি।
সাহিত্য উৎসবে বিক্রম ও লীলা শেঠ। ছবি: অনিন্দ্য শঙ্কর রায়
স্বামী প্রেমো শেঠের কথাও বললেন লীলা, “ছেলেমেয়েদের ‘স্পেস’ দিতে পেরেছিলাম, কারণ স্বামী আমাকে তা দিয়েছিলেন। আমার চাকরি করা, বিলেতে গিয়ে আইন পাশ করা, আদালতে প্র্যাকটিস করা সব কিছুতেই স্বামী আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন।” লীলার আত্মজীবনীতে স্বাধীনতা-পরবর্তী আমলে কলকাতা হাইকোর্টের বিখ্যাত ব্যারিস্টার শচীন চৌধুরীর কথা আছে। তাঁর কাছে ‘জুনিয়র’ হয়ে প্র্যাকটিস করার জন্য গিয়েছেন। শচীনবাবু বললেন, ‘ইয়াং লেডি, আইন-ব্যবসায় কেন? বিয়ে-থা করে সংসার করুন।’ উত্তরে লীলা জানালেন, তিনি বিবাহিতা। এবং দুই সন্তানের মা। হতভম্ব ‘সিনিয়র’ বললেন, আগামী কাল ‘জয়েন’ করুন।
ছেলেদের দৌরাত্ম্য? ছোট্ট বিক্রম জেদি। মায়ের এক বান্ধবীর মুখে মুখে কথা বলেছে, যতক্ষণ না ‘সরি’ বলবে, মা ঘরের কোণে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। শেষে মায়েরই ধৈর্য গেল ভেঙে, ‘সরি বলার ইচ্ছা আছে?’ ছেলে বলল, ‘আছে।’ ওইটুকুই। ‘সরি’ সে উচ্চারণ করবে না!
বড় ছেলের যৌনতার কথাও লিখেছেন লীলা। বিক্রম উভকামী জানার পর কতটা ‘শক্ড’ হয়েছিলেন, রয়েছে তাঁর আত্মজীবনীতে। “তখনও দিল্লি হাইকোর্টের আইন আসেনি। সমকামিতা তখনও নিষিদ্ধ। ফলে চিন্তা তো হয়েইছিল। কিন্তু বইটা পড়ে বেশ কয়েক জন মা আমাকে ফোন করেছিলেন। স্বীকার করেছিলেন, তাঁরা ব্যাপারটা ভুল ‘হ্যান্ডল’ করছিলেন। সমকামী সন্তানকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন,” বললেন লীলা।
মা-ছেলের পরে এ দিন ‘রবীন্দ্রনাথের প্রভাব’ নিয়ে একটি অধিবেশনে ছিলেন ভুটানের ভারতীয় রাষ্ট্রদূত পবন বর্মা। গালিব থেকে গুলজার, অটলবিহারী বাজপেয়ী অনেকের ‘শায়রি’ ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন পবন। সদ্য বেরিয়েছে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘হোয়েন লস ইজ গেইন’। জয়পুর সাহিত্য উৎসব থেকে কলকাতায় এসে স্পষ্টবক্তা রাষ্ট্রদূত একটি বোমা ফাটালেন। “রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষ নিয়ে নানা কথা বলা হয়, কিন্তু রবীন্দ্ররচনা অনুবাদ করে ছড়ানোর ব্যাপারে কাজের কাজ কতটা হয়েছে? ‘বিশ্বভারতী’ সে রকম উদ্যোগ নেয়নি, ষাট বছর ধরে তারা ‘মনোপলি’ বজায় রাখতেই তৎপর ছিল। আর অনুবাদের ব্যাপারে ‘সাহিত্য অকাদেমি’ও তথৈবচ। বই তৈরি থেকে বিপণন...কোত্থাও পেশাদারি ছাপ নেই,” আড্ডা মারতে মারতে বললেন তিনি।
এক দিকে অনুবাদকের অভিমান। অন্য দিকে মা-ছেলের খুনসুটি। শেষ হল শহরের প্রথম সাহিত্য উৎসব!
পুনশ্চ: শেষ দিন ‘অশান্ত সময় সাহিত্যের আঁতুড়ঘর’ নিয়ে অধিবেশনে শুধুই দুই বাঙালি লেখক। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ও জয়া মিত্র। কাশ্মীরের লেখক বশরত পীরের ‘কারফিউড নাইট’ থেকে অনেক ভারতীয় উপন্যাসেই আজকাল অশান্ত সময়ের ছায়া। প্রথম উৎসবে বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে কিন্তু সে ভাবে অন্যদের আদানপ্রদান হল না!
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.