দীনেশ দাস তাঁত চালাতেন। বংশানুক্রমিক এই পেশা ছেড়ে তিনি এখন দিল্লিতে রাজপথে রিকশা চালান। একদা তাঁত শ্রমিক হরিহর দেবনাথ এখন প্রতিমা তৈরির কাজ করেন। নারায়ণ দাস অন্ধ্রপ্রদেশ চলে গেছেন মণ্ডপ তৈরির শ্রমিক হয়ে। আর অনন্ত দেবনাথ পাড়ি দিয়েছেন মুম্বই। মাসে পাঁচ হাজার টাকার পারিশ্রমিকে হোটেলে কাজ করেন।
বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়। নবদ্বীপ ব্লকের বিভিন্ন গ্রাম থেকে এ বাভেই হারিয়ে যাচ্ছেন তাঁত শ্রমিকেরা। স্থানীয় প্রশাসন সূত্রেই জানা গিয়েছে তাঁরা এখন দলে দলে পাড়ি দিচ্ছেন ভিন রাজ্যে। হোটেল কর্মী থেকে রাজমিস্ত্রী। রিকশা চালক থেকে নির্মাণকর্মীনিজেদের শিল্প বেচে আশা ছেড়ে দিল্লি, মুম্বই, হয়দরাবাদে রুজির টানে পানি দিচ্ছেন তাঁরা।
সম্প্রতি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে নবদ্বীপের আশপাশে বেশ কিছু গ্রাম আছে যেখানে ৭০ শতাংশ পুরুষই বর্তমানে গ্রাম-ছাড়া। নবদ্বীপ তাঁত বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সম্পাদক সুভাষ পোদ্দার বলেন, ‘‘৮০ শতাংশ তাঁত শ্রমিক আজ তাদের পুরোনো পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। দলে দলে পাড়ি দিচ্ছে ভিন রাজ্যে। ফলে এই শিল্পে চরম শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে।”
শুধু তাঁত শ্রমিকরাই নন, দিনের পর দিন লোকসান স্বীকার করে, শ্রমিকের অভাবে ছোট আর মাঝারি মানের তাঁত মালিকরাও এ ব্যবসা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন। বিক্রি করে দিচ্ছেন তাঁত। কুড়ি-পঁচিশটা তাঁত-মেশিন বিক্রি করে দিয়ে কেউ কেউ একটা করে যন্ত্রচালিত তাঁত বা পাওয়ার লুম কিনে কোনও রকমে ব্যবসাটা টিকিয়ে রেখেছেন। কেউবা পুঁজি গুটিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছেন অন্য পেশায়। |
তাঁতঘর এখন অতীত। —ফাইল চিত্র। |
নবদ্বীপের চর ব্রহ্মনগর গ্রামের তাঁত মালিক ভজন দেবনাথ বলেন, “কাপড়ের দাম পাচ্ছি না। তার উপর শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। বাধ্য হয়েই বছর দুয়েক আগে ৫০টি তাঁতের মধ্যে ৩০টা তাঁত বিক্রি করে দিয়েছি। ২০ টার মধ্যে ৫টি চলাই। বাকি তাঁত পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। ভাবছি সেগুলোও বিক্রি করে দেব।” বছর কয়েক আগেও এই চর ব্রহ্মনগর গ্রামেই চলত প্রায় ২০ হাজার তাঁত। এখন সেটা কমতে কমতে খুব বেশি হলে হাজার দেড়েক-এ এসে ঠেকেছে। আর এক তাঁত মালিক দিলীপ দেবনাথ বলেন, “একটা তাঁত তৈরি করতে কম করে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। কিন্তু বিক্রি করছি মাত্র ৩ হাজার টাকায়। তাঁত দিয়ে খাট তৈরি হচ্ছে। চোখের সামনে এ সব দেখছি আর বুকটা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুই করার নেই। দু’এক বছরের মধ্যে সবটাই শেষ হয়ে যাবে।”
গ্রাম বাংলারয় নবদ্বীপের তাঁতের কদর বহু দিনের। ফুলিয়ার শাড়ি বিখ্যাত সূক্ষ্মকাজের জন্য। শান্তিপুরের শাড়ি বিখ্যাত নক্সার জন্য। আর নবদ্বীপের মোটা সুতোর কাপড়ের শাড়ির জন্য বিখ্যাত ছিল। দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মহিলারা, বিশেষ করে কৃষক পরিবারের মহিলাদের মধ্যে এই শাড়ির বিশেষ চাহিদা ছিল। আটপৌড়ে শাড়ি হিসাবে নবদ্বীপের মোটা কাপড়ের কোনও জুরি ছিল না বাংলায়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি বদলেছে। সুতোর অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি। যন্ত্রচালিত তাঁতে তৈরি ভয়েল সুতোর ছাপা শাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে না ওঠা এমনই সব নানা কারণে মুখ থুবড়ে পড়ছে নবদ্বীপের তাঁত শিল্প।
পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না শ্রমিকরা। ফলে তাঁরা পেশা ছেড়ে পাড়ি দিচ্ছেন ভিন রাজ্যে। ফলে শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। হাতে গোনা যে কটি হস্তচালিত তাঁত চলছে সেগুলির বেশির ভাগই চালাচ্ছেন মহিলা শ্রমিকরা। দিল্লিতে রিকশাচালক দীনেশ দাস যেমন বলেন, “এই পেশায় থাকলে পরিবার নিয়ে না খেয়ে মরতে হত। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তাঁত চালিয়ে ৭০ টাকার বেশি আয় করতে পারতাম না। তাও সব দিন কাজ মিলত না। বাধ্য হয়েই দিল্লি গিয়ে রিকশা চালাচ্ছি।”
|