গাজলে আত্মঘাতী চাষি, ধর্মঘটে কৃষক সভাও
ক দিন দক্ষিণবঙ্গে তো পরের দিনই উত্তরে।
ফসলের দাম না পেয়ে রাজ্যে চাষি আত্মহত্যার অভিযোগ এবং তা নিয়ে রাজনীতি অব্যাহত।
রবিবার সকালে মালদহের গাজলে কীটনাশকের বিষে দয়ালচন্দ্র বর্মন (৫২) নামে এক চাষির মৃত্যু হয়। পরিবারের অভিযোগ, সরকার ধান না কেনায় ঋণে জড়িয়ে পড়া ওই প্রৌঢ় আত্মঘাতী হয়েছেন। এ দিনই বামপন্থী কৃষক সংগঠনগুলির তরফে জানানো হয়, আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি শ্রমিকদের ডাকা দেশ জোড়া সাধারণ ধর্মঘটে সামিল হয়ে তারা গ্রামবাংলায় বন্ধ পালন করবে। বামফ্রন্ট অবশ্য ইতিমধ্যেই কংগ্রেস, বিজেপি এবং বামপন্থী কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির ডাকা ওই ধর্মঘটে সমর্থন জানিয়েছে।
শনিবারই বর্ধমানের কেতুগ্রামে এক ধানচাষি আত্মঘাতী হয়েছিলেন। কৃষক সভার দাবি, এখনও পর্যন্ত শুধু ওই জেলাতেই ২০ জন চাষি আত্মহত্যা করেছেন। রাজ্যে সংখ্যাটা ২৯। বর্ধমানে কেন এত চাষি আত্মঘাতী হচ্ছেন, তা খতিয়ে দেখতে দু’টি সংস্থাকে সমীক্ষা করতে বলেছে বামপন্থী কৃষক সংগঠনগুলি। রবিবার দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তথা কৃষক সভার রাজ্য সভাপতি মদন ঘোষ অভিযোগ করেন, “ধান ঠিক মতো কেনা হচ্ছে না বলেই আত্মহত্যা বাড়ছে। চাল কলে অনেকটা ধানই অন্য রাজ্য থেকে আসছে। গ্রামে ১০০ দিনের কাজ মিলছে না। মহিলা ও বৃদ্ধ-সহ বিভিন্ন অংশের মানুষের ভাতা বন্ধ। সরকার ঘুমিয়ে আছে কি না, বুঝতে পারছি না! ২৮ ফেব্রুয়ারি গ্রামবাংলাতেও বন্ধ হবে।”
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি বাদে অন্য কোনও ক্ষেত্রে চাষি মৃত্যুর কথা স্বীকার করেননি। জোটের স্বার্থে কংগ্রেস হাইকম্যান্ডও রাজ্যের নেতা-কর্মীদের ‘কৃষক আন্দোলন’ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছে। কিন্তু কার্যত ‘রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা’ থেকেই তাঁদের অনেকে সরব হচ্ছেন। এ দিন যেমন উত্তর মালদহের সাংসদ তথা প্রদেশ যুব কংগ্রেস সভাপতি মৌসম বেনজির নুর বলেন, “আমার এলাকায় এই নিয়ে পরপর দুই চাষি আত্মঘাতী হলেন। দ্রুত সরকারি দামে ধান কেনা না হলে আরও অনেকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হবেন।”
হবিবপুরে আত্মঘাতী কৃষক হরিদাস রত্নের বাড়িতে শ্যামল চক্রবর্তী ও মহম্মদ সেলিম।
অন্য দিকে, বিধানসভা নির্বাচনে বিপর্যয়ের পরে চাষি মৃত্যু নিয়েই ফের কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে সিপিএম। এ দিনই মালদহের হবিবপুরে আত্মঘাতী চাষি হরিদাস রত্নের বাড়ি ও আশপাশের এলাকায় গিয়ে পরিস্থিতি দেখে আসেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির দুই সদস্য মহম্মদ সেলিম ও শ্যামল চক্রবর্তী। সেলিমের কটাক্ষ, “আজও গাজলে এক কৃষক ধান বিক্রি করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এরা চাষি নন।” শিলিগুড়িতে দলের পলিটব্যুরো সদস্য তথা রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী নিরুপম সেন অভিযোগ করেন, “কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়োগের অভাব, বেসরকারিকরণ, ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। মহাজনি ঋণ শোধ করতে না পেরে তাঁরা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন।”
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গাজলের ডুহুচি গ্রামের চাষি দয়াল বর্মনের নিজের এক বিঘা জমি ছিল। তিন বিঘা জমিতে ভাগচাষ করতেন। বছরের অন্য সময়ে কাঠমিস্ত্রির কাজও করতেন। বড় ছেলে উত্তম দিনমজুরির কাজে মুম্বই গিয়েছেন। ছোট ছেলে কৃষ্ণ অন্যের ট্রাক্টর চালান। থাকেন অন্যত্র। কয়েক মাস আগে এক মাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে। এ দিন বেলা ১১টা নাগাদ তিনি ছটফট করতে করতে বাড়ি ফেরেন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই তাঁর মৃত্যু হয়।
মৃতের ভাই গঙ্গাধর বর্মনের অভিযোগ, “মহাজনের থেকে ২৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে আড়াই বিঘা জমিতে ধান ও দেড় বিঘা জমিতে গম লাগিয়েছিলেন দাদা। ভাল ধান হয়েছিল। গম এখনও মাঠে। কিন্তু হাটে ফড়েরা ৪০ কেজি ধানে ৩৪০ টাকার (সরকারি দাম ৪৩২ টাকা) বেশি দিচ্ছে না। মেয়ের বিয়েতেও দাদা মহাজনের কাছ থেকে ঋণ করেছিলেন। ভেবেছিলেন, ধান বিক্রি করে সব শোধ করবেন। হতাশায় কীটনাশক খেয়েছেন।”
গাজলে আত্মঘাতী কৃষক দয়ালচন্দ্র বর্মন।
গাজলের বিডিও আফজল হোসেনের মতে, ওই ব্লকে পাঁচটি চালকল সরকারি মূল্যে ধান কিনলেও যাঁরা কম ধান বিক্রি করবেন তাঁদের অনেকেই দূরত্ব বা চেকে দাম পাওয়ার কারণে সেখানে যেতে চান না। স্থানীয় বাবুপুর পঞ্চায়েতের সিপিএম প্রধান সিরাজুল ইসলাম বলেন, “দু’দিন আগে দয়াল বর্মনের বাড়িতে গিয়ে ধান পড়ে থাকতে দেখি। দুশ্চিন্তা করছিলেন, কী করে মহাজনের ঋণের টাকা শোধ করবেন?”
রাজ্যের নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী তথা তৃণমূলের জেলা সভাপতি সাবিত্রী মিত্র অবশ্য দাবি করেন, “কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা আমার জানা নেই।” মালদহের জেলাশাসক শ্রীমতি অর্চনাও বিকেলে বলেন, “কৃষক আত্মহত্যা করেছেন বলে বিডিও-র কাছ থেকে কোনও রিপোর্ট পাইনি।” বিডিও-র বক্তব্য, “ওই চাষির বাজারে অনেক দেনা ছিল। তবে ওই এলাকায় ১০০ দিন প্রকল্পে অনেক কাজ হচ্ছে। উনি কাজ চেয়েছিলেন বা পেয়েছিলেন কি না তা খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।”
কৃষক সভার তরফে মদন ঘোষ জানান, সরকারের ‘উদাসীনতা’র প্রতিবাদে ১ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি ব্লক এবং মহকুমা স্তরে অবস্থান-বিক্ষোভ করা হবে। যদিও এ দিন কেতুগ্রামের কৌড়িগ্রামে আত্মঘাতী চাষি ভূতনাথ পালের বাড়িতে গিয়ে বর্ধমান জেলা কংগ্রেস নেতারা এই পরিস্থিতির জন্য বিগত বাম সরকারকেই দায়ী করেছেন। নদিয়ার গাংনাপুরে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য আবার আক্ষেপ করেন, “বলা হচ্ছে, বাম জমানার চেয়ে কম চাষি আত্মঘাতী হচ্ছেন। আমাদের প্রশ্ন, এক জনও আত্মহত্যা করবেন কেন?”
দেশ জুড়ে সাধারণ ধর্মঘট ডাকার ক্ষেত্রে বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনগুলি কংগ্রেস ও বিজেপি-র হাত ধরলেও রাজ্যে কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রে যে তাঁরা বাম ভিন্ন অন্য কোনও দলকে সঙ্গে নিতে নারাজ, তা মদনবাবু স্পষ্ট করে দিয়েছেন। সম্প্রতি চাষিদের দাবি নিয়ে এক সমাবেশে তাঁদের আহ্বান জানিয়ে চিঠি দিয়েছিল বিজেপি। কিন্তু সরাসরি বিজেপি-র নাম থাকায় তাঁরা সেই আহ্বান গ্রহণ করেননি। মদনবাবু বলেন, “কৃষক সংগঠনের তরফে কেউ আমাদের সঙ্গে আন্দোলনে এগিয়ে এলে আমরা স্বাগত জানাব। তবে অন্য কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যাব না।”

ছবি: মনোজ মুখোপাধ্যায়



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.