জেলার হাসপাতাল থেকে ‘সঙ্কটজনক’ অবস্থায় কোনও শিশুকেই কলকাতার বিধানচন্দ্র রায় শিশু হাসপাতালে পাঠানো যাবে না বলে নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেই নির্দেশ যে মানা হচ্ছে না, ২৪ ঘণ্টায় জেলা হাসপাতাল থেকে বিধানচন্দ্র রায় হাসপাতালে পাঠানো পাঁচটি শিশুর মৃত্যুর ঘটনা তারই প্রমাণ। এই ঘটনা প্রমাণ করছে, জেলা হাসপাতালগুলিতে নবজাতকদের চিকিৎসার যথাযথ পরিকাঠামো এখনও গড়ে তোলা যায়নি।
বিধানচন্দ্র রায় হাসপাতাল সূত্রের খবর, সেখানে পাঁচটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে শনিবার মাঝরাত থেকে রবিবার সন্ধ্যার মধ্যে। প্রতিটি শিশুরই বয়স কমবেশি দু’মাস। শিশুগুলি নিউমোনিয়া এবং অন্য শ্বাসজনিত সমস্যায় ভুগছিল। বিভিন্ন জেলার হাসপাতাল সঙ্কটজনক অবস্থায় তাদের ‘রেফার’ করেছিল বি সি রায় হাসপাতালে।
রোগীদের আত্মীয়স্বজন অবশ্য হাসপাতালের এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তাঁদের অনেকেই হাসপাতাল-চত্বরে বিক্ষোভ দেখান। অবরোধ করা হয় নারকেলডাঙা মেন রোড। রবিবার সন্ধ্যায় ওই রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আটকে যায় হাসপাতালমুখী অ্যাম্বুল্যান্সও। পুলিশ গিয়ে অবরোধ তুলে দেয়। হাসপাতাল-চত্বরে পুলিশ
|
সন্তানহারা মা। — নিজস্ব চিত্র |
মোতায়েন করা হয়েছে।
অবরোধ-বিক্ষোভ কেন?
অবরোধকারীদের একাংশের অভিযোগ, কলকাতার হাসপাতালে আনার পরেও চিকিৎসকেরা শিশুদের যথাযথ পরিচর্যা ও চিকিৎসা করেননি। বিভাস ঘোষ নামে বসিরহাটের এক বাসিন্দা বলেন, “আমার দু’মাসের ছেলেকে ভর্তি করেছিলাম। ডাক্তারেরা কখনও বলেন ‘জন্ডিস’, কখনও বলেন, ‘ঠান্ডা লেগেছে’। রবিবার ভোর ৩টেয় ছেলে মারা গেল।” সন্তানের খবর নিতে গিয়ে নিগৃহীতও হতে হয়েছে বলে অভিযোগ করলেন মায়েরা। সুনীতা হালদারের অভিযোগ, “আমার ছেলে সৌমিকের খোঁজখবর নিতে গেলে হাসপাতালের রক্ষীরা আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়।” দক্ষিণ ২৪ পরগনার জাভেদা বিবিও হাসপাতাল-কর্মীদের অমানবিক ব্যবহারের শিকার। জাভেদা বলেন, “আমার নাতিকে নোংরা বিছানায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। এক নার্সকে সেটা বদলে দিতে বলতেই জবাব এল, ‘বাচ্চাকে নিয়ে চলে যান’।”
অবরোধকারীদের মধ্যে ছিলেন বনগাঁর নারায়ণ দত্তও। তাঁর এক প্রতিবেশীর ছেলেকে জেলা হাসপাতাল ন্যূনতম চিকিৎসা না-করেই কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ নারায়ণবাবুর। তাঁর মন্তব্য, “জেলার হাসপাতাল ঠিকমতো চিকিৎসা করলে দুধের শিশুগুলিকে এতটা পথ এ ভাবে নিয়ে আসতে হত না। পথের ধকল সহ্য করার মতো শক্তিই তো থাকে না ওদের।”
মাস তিনেক আগে, অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ১৩টি শিশুর মৃত্যু হয়েছিল বিধানচন্দ্র হাসপাতালে। তার আগে, জুনে ৪৮ ঘণ্টায় ১৮টি শিশু মারা যায়। দু’টি ঘটনা নিয়েই বিতর্ক বাধে। জুনের ঘটনার পরে মুখ্যমন্ত্রী ওই শিশু হাসপাতালে যান। শিশুমৃত্যুর ঘটনার তদন্তেরও নির্দেশও দেন তিনি। সেই সঙ্গেই নির্দেশ দিয়েছিলেন, জেলার হাসপাতাল থেকে কলকাতার হাসপাতালে ‘রেফার’ ব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে।
সেই নির্দেশ কতটা কার্যকর হয়েছে, প্রশ্ন তুলে দিয়েছে এ দিনের শিশুমৃত্যুর ঘটনা। বিধানচন্দ্র হাসপাতালের সুপার দিলীপ পাল বলেন, “ওই শিশুদের জেলা এবং মফস্সলের বিভিন্ন জায়গা থেকে আনা হয়েছিল সঙ্কটজনক অবস্থায়। অন্যান্য হাসপাতাল থেকে তাদের এখানে রেফার করা হয়েছিল।” জেলার হাসপাতালের বক্তব্য, চিকিৎসার যথাযথ পরিকাঠামো নেই বলেই ‘সঙ্কটজনক’ অবস্থায় শিশুদের কলকাতায় পাঠাতে বাধ্য হচ্ছে তারা।
বিধানচন্দ্র হাসপাতালের সুপার জানান, ওই শিশুরা নিউমোনিয়া এবং শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যায় ভুগছিল। কোন পরিস্থিতিতে শিশুগুলির মৃত্যু হল, চিকিৎসায় কোনও গাফিলতি ছিল কি না এবং কর্মীদের ব্যবহার কেমন ছিল, তা নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ। আজ, সোমবার স্বাস্থ্য ভবনে সেই তদন্তের রিপোর্ট জমা পড়ার কথা।
জেলা থেকে ‘রেফার’ বন্ধ করার নির্দেশ না-মানার ব্যাপারে কী বলছে স্বাস্থ্য দফতর?
স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “সকলকেই তো রেফার করতে বারণ করা হচ্ছে। কিন্তু তা ঠেকানো যাচ্ছে না। হাসপাতালে নিয়ে এলে তো ফেরানো যায় না।”
সম্প্রতি মালদহ, বর্ধমান-সহ বিভিন্ন হাসপাতালে শিশুমৃত্যুর পরে সেখানে বিক্ষোভ হয়েছে। এ দিন বিধানচন্দ্র হাসপাতালের বিক্ষোভ উঠে আসে বড় রাস্তায়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে প্রতিটি ক্ষেত্রেই। স্বাস্থ্য দফতরের কাছে সেটাও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সুশান্তবাবু বলেন, “শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটলেই এই ধরনের বিক্ষোভ হচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে, সেই বিষয়ে আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি।” |