|
|
|
|
জেলা সম্পাদক বদল মালদহেও |
উত্তর ২৪ পরগনার ভার পেলেন গৌতম |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা ও মালদহ |
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, এক ‘ওজনদার’ নেতাকে পাঠানো হল অত্যন্ত ‘গুরুত্বপূর্ণ’ একটি জেলার দায়িত্বে। আবার এসএফআই এবং ডিওয়াইএফআই-এর জেলা নেতৃত্ব এবং লোকাল ও জোনাল কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসা এক ‘নতুন মুখ’কে তুলে আনা হল আর একটি জেলার শীর্ষ পদে।
একই দিনে দক্ষিণ ও উত্তরবঙ্গের দুই জেলায় এমন তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটল সিপিএমে। উত্তর ২৪ পরগনার সম্মেলনে দলের নতুন জেলা সম্পাদক হলেন প্রাক্তন মন্ত্রী এবং ‘ডাকসাইটে’ নেতা গৌতম দেব। যাঁর জন্য কেন্দ্রীয় কমিটি এবং রাজ্য কমিটি তথা রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যকেও জেলার দায়িত্বে পাঠানোর ব্যাপারে পলিটব্যুরোর ‘অনুমোদন’ আনিয়ে রাখছে আলিমুদ্দিন (এর আগে হুগলির বিজয় মোদক জেলা সম্পাদক থাকাকালীন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হয়েছিলেন)। আর রবিবারই মালদহের জেলা কমিটির বৈঠক করে জীবন মৈত্রকে ‘অব্যাহতি’ দিয়ে নতুন জেলা সম্পাদক করা হল অম্বর মিত্রকে। জীবনবাবুর মতোই বয়সজনিত কারণে উত্তর ২৪ পরগনার দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ালেন অমিতাভ বসু।
দুই জেলায় দুই ‘পরিবর্তনের’ মধ্যে ধারে-ভারে অবশ্যই গৌতমবাবুর জেলা সম্পাদক হওয়ার ঘটনা বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। সাবেক আমল থেকেই উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সিপিএম গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের জন্য ‘কুখ্যাত’। সিপিএম সূত্রের খবর, অমিতাভ বসু দায়িত্ব ছাড়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করার পর থেকেই জেলা সম্পাদক হওয়ার দৌড়ে ছিলেন প্রাক্তন সাংসদ অমিতাভ নন্দী। কিন্তু এ বারের সম্মেলনে তাঁকে আটকাতে ‘একজোট’ হয়েছিলেন তড়িৎ তোপদার, রঞ্জিৎ কুণ্ডু, মানস মুখোপাধ্যায়, পল্টু দাশগুপ্তের মতো এলাকা-ভিত্তিক নেতারা। সমস্যা দেখা দিয়েছিল, এঁদের মধ্যে কেউ সম্পাদক হলেই অন্য গোষ্ঠী থেকে ‘বিরোধিতা’ আসত। এমতাবস্থায় আলিমুদ্দিন আস্তিনের তাস হিসেবে বার করেছে গৌতমবাবুকে। অমিতাভবাবুকে আটকানোর জন্য যাঁর ‘নেতৃত্বে’ একাধিক নেতা আসরে নেমেছিলেন, তাঁকেই দেওয়া হল জেলার দায়িত্ব।
বস্তুত, গৌতমবাবুকে জেলা সম্পাদক করার পিছনে নেপথ্য ভূমিকায় থেকেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ‘পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির’ কেউ দায়িত্বে আসুন, এমনই চাইছিলেন বুদ্ধবাবু। সিপিএম সূত্রের ব্যাখ্যায়, গৌতমবাবুকে জেলা সম্পাদক হিসেবে ‘এগিয়ে দিয়ে’ এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছেন বুদ্ধবাবুরা। এক দিকে যেমন গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বে দীর্ণ জেলায় গৌতমবাবুর মতো ‘ওজনদার’ নেতাকে পাঠিয়ে দল সামলাতে সুবিধা হবে, তেমনই আলিমুদ্দিনের পার্টি কেন্দ্রের থেকে জেলার দায়িত্ব সামলাতেই আপাতত বেশি ‘ব্যস্ত’ রাখা যাবে প্রাক্তন আবাসনমন্ত্রীকে। উপরন্তু, গৌতমবাবু সম্পাদক হওয়ায় উত্তর ২৪ পরগনার মতো গুরুত্বপূর্ণ জেলায় আলিমুদ্দিনের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ রাখারও সুযোগ থাকবে। দমদমে জেলা সম্মেলনের শেষ দিনে রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু এবং বিনয় কোঙার, রঘুনাথ কুশারীর মতো রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যদের উপস্থিতিতে জেলা সম্পাদক হয়েছেন গৌতমবাবু। |
গৌতম দেব |
জীবন মৈত্র |
|
গত বিধানসভা নির্বাচনে যে দমদমে ব্রাত্য বসুর কাছে হেরে রাজনৈতিক জীবনে ধাক্কা খেয়েছিলেন গৌতমবাবু, সেই দমদম থেকেই তাঁর নতুন ইনিংস শুরু হচ্ছে এ-ও এক সমাপতন! নতুন দায়িত্ব পেয়ে গৌতমবাবু এ দিন বলেছেন, “দোষ-ত্রুটি শুধরে জেলায় আন্দোলনকে সুদৃঢ় করতে হবে। বিমানদা বলেছেন, পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে। সবার আগে সেই পরিবর্তন হবে উত্তর ২৪ পরগনাতেই!” জেলা সম্পাদক হয়েই গৌতমবাবুর লক্ষ্য, আসন্ন ব্রিগেড সমাবেশে দু’লক্ষ লোক নিয়ে যাওয়া। যে প্রসঙ্গে অমিতাভ নন্দী বলেছেন, “আমরা ঐক্যবদ্ধ ভাবে শিল্পাঞ্চল থেকে মিছিল করে ব্রিগেডে যাব।” আর বিদায়ী সম্পাদক অমিতাভ বসুর বক্তব্য, “নতুন পরিস্থিতিতে নতুন সম্পাদক সকলকে নিয়ে কাজ করবেন। আমরা সহযোগিতা করব।”
মালদহের জীবনবাবু জেলা সম্পাদকের পদ ছাড়তে চেয়েছিলেন আগেই। কিন্তু ‘পরিস্থিতির বিচারে’ জেলা সম্মেলনে তাঁর ইচ্ছা মঞ্জুর করা হয়নি। নবগঠিত জেলা কমিটির বৈঠকে এ দিন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শ্যামল চক্রবর্তী, মহম্মদ সেলিম, শ্যামলী গুপ্তের উপস্থিতিতে তাঁর জায়গায় নতুন জেলা সম্পাদক হয়েছেন ৫৩ বছরের অম্বরবাবু। তিনিও দলের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীতেই ছিলেন। শ্যামলবাবুর কথায়, “অসুস্থতার জন্য জীবনবাবু জেলা সম্পাদক হিসেবে কাজ করতে পারছেন না বলে জানিয়েছিলেন। সেই কারণেই তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হল।” প্রসঙ্গত, এর আগে নদিয়া জেলাতেও সম্মেলনে আশু ঘোষ ‘অন্তর্বর্তী সম্পাদক’ থেকে গিয়েছিলেন।
পরে জেলা কমিটির বৈঠক থেকে নতুন সম্পাদক করা হয় সুমিত দে-কে।
১৯৮৪ ও ১৯৯১ সাল ছাড়া মোট ৯ বার জেলা সম্পাদক পদে ছিলেন জীবনবাবু। তিনি এ দিন স্পষ্ট করেই বলেছেন, “আমার বয়স হয়েছে। অসুস্থ হয়ে পড়েছি। অনেক দিন ধরেই রাজ্য কমিটিকে বলছিলাম, আমাকে অব্যাহতি দেওয়া হোক। জেলা কমিটির সভায় এ দিন সকলে একমত হয়ে আমায় অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমি চাই, নতুন প্রজন্ম উঠে আসুক।” শ্যামলবাবুর সংযোজন, ‘মাত্র এক মিনিটের মধ্যে সর্বসম্মত ভাবে’ নয়া জেলা সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। রাজ্যসভার সাংসদ বলেন, “জেলা সম্মেলনের সময়েই নয়া জেলা সম্পাদক নির্বাচন করব ঠিক করেছিলাম। শৈলেন সরকার অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেই কাজ আটকে ছিল। এ দিনের বৈঠকে শৈলেনবাবুও উপস্থিত ছিলেন।”
মালদহের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং দলের ‘গোষ্ঠী-কোন্দল’ সামাল দেওয়া গৌতমবাবুর মতো অম্বরবাবুর কাছেও নতুন চ্যালেঞ্জ। যিনি এ দিন বলেছেন, “জেলার মানুষের দাবি-দাওয়া নিয়ে লাগাতার আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করব।” জেলা সিপিএম সূত্রের খবর, অম্বরবাবু ১৯৮২ সালে এসএফআই এবং ১৯৮৭ সালে ডিওয়াইএফআই-এর জেলা সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯৪ সালে ইংরেজবাজার টাউন লোকাল কমিটির সম্পাদক, ২০০৪ সালে ইংরেজবাজার জোনাল কমিটির সম্পাদক হয়েছিলেন।
উত্তর ২৪ পরগনায় ৭৯ জনের জেলা কমিটি নেমে এসেছে ৭০-এ। যে ২৪ জন বাদ গিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন প্রাক্তন মন্ত্রী কান্তি বিশ্বাস, দেবব্রত বসু, লক্ষ্মণ ভট্টাচার্য, জগদীশ দাস, রবি দত্ত, প্রণব ভট্টাচার্য, প্রণব মজুমদার, রবি দত্ত প্রমুখ। নতুন ১৩ জনের মধ্যে এসেছেন দুলাল চক্রবর্তী, দেবজ্যোতি দাস, সায়নদীপ মিত্র, শুক্লা চক্রবর্তী, আত্রেয়ী গুহ, শ্রীদীপ রায়চৌধুরী প্রমুখ। তবে জেলায় প্রায় ২৬% সংখ্যালঘু জনসংখ্যা থাকা সত্ত্বেও জেলা কমিটিতে সে ভাবে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব না-থাকায় ক্ষোভ রয়েছে দলের একাংশে। দলীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সম্মেলনে উঠে-আসা সমালোচনার বিশেষ জবাব দেননি বিমানবাবু। জবাবি ভাষণে তাঁর জোর ছিল তৃণমূলের নানা ‘অন্যায়’ এবং জেলায় ‘সন্ত্রাসের’ প্রতিই। একই সঙ্গে তিনি বলেন, “এই জেলার সোনার মাটিতে সোনা ফলবে”!
সোনা ফলানোর জন্য হাল এখন ধরতে হবে গৌতমবাবুকে! |
|
|
|
|
|