গ্র্যান্ড স্লাম ফাইনালের ইতিহাসে দীর্ঘতম ম্যাচে ৫-৭, ৬-৪, ৬-২, ৬-৭ (৫-৭), ৭-৫ সেটে রাফায়েল নাদালকে হারিয়ে অস্ট্রেলীয় ওপেন চ্যাম্পিয়ন হল নোভাক জকোভিচ। বিশ্বের এক বনাম দুই নম্বর টেনিস প্লেয়ারের ৫ ঘণ্টা ৫৩ মিনিট ব্যাপী গ্র্যান্ড স্লাম ফাইনাল যুদ্ধ। তবু দুপুর থেকে সন্ধে পর্যন্ত টিভির সামনে ঠায় বসে থেকে এক জন প্রাক্তন টেনিস প্লেয়ার হিসেবে আমার কিন্তু মন ভরল না। বেশির ভাগটাই শরীর সর্বস্ব টেনিস। চূড়ান্ত ফিজিক্যাল। দুই মহারথীরই ফিটনেস প্রদর্শনের শেষ কথা। সেই বৈচিত্র কোথায়? সেই টাচ! ভলি! চকিত ড্রপ শট! যা লেভার থেকে বর্গ, এমার্সন থেকে কোনর্স, কিংবা আগাসির খেলায় দেখেও টেনিসপ্রেমীরা মুগ্ধ হত!
জকোভিচ বা নাদালের কৃতিত্বকে এতটুকু ছোট করে দেখানোর ইচ্ছে আমার নেই। কিন্তু বলুন তো, বিশ্ব রেকর্ড তৈরি করা এত দীর্ঘস্থায়ী ম্যাচও কিছু দিন পরেই কারও মনে থাকবে কি না? এক-এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে এক-একটা সেট চলেছে রবিবার রাত দেড়টা পর্যন্ত মেলবোর্ন পার্কের রিবাউন্ড হার্ডকোর্টে। কিন্তু পাঁচটা সেট মিলিয়ে পাঁচটা মুহূর্তও খেলায় তৈরি হয়েছে কি, যেটা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে? |
বেশি পুরনো দিনে যাব না। বছর কয়েক আগে অস্ট্রেলীয় ওপেন ফাইনালেই ফেডেরার বনাম নাদাল অথবা, ওদের মধ্যেই উইম্বলডন ফাইনালের কথা টেনিসমহলের মুখে-মুখে এখনও বারবার ফিরে আসে। মোদ্দা কথা, সর্বকালের দীর্ঘতম গ্র্যান্ড স্লাম ফাইনাল কিন্তু মোটেই ক্লাসিক ম্যাচের পর্যায়ভুক্ত হয়ে থাকছে না। বড়জোর মরণপণ লড়াই, সর্বোচ্চ পর্যায়ের ফিটনেস, সহনশীলতার সেরা উদাহরণ হয়ে থাকবে গ্র্যান্ড স্লাম টেনিসের ইতিহাসে।
ম্যাচটা এ দিন জকোভিচ চার সেটেই জিততে পারত। প্রথম সেট হেরে পরের দুটো সেট দাপটে জিতে চতুর্থ সেটে ম্যাচ পকেটে পুরে ফেলার মোক্ষম সুযোগ পেয়েছিল জকোভিচ। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে বার কয়েক ফাইনাল আংশিক বিঘ্নিত হওয়ার ঘটনায় তখন নাদাল আচমকা অধের্য হয়ে উঠে নিজের খেলার ওপর নিয়ন্ত্রণ একটু হলেও হারিয়ে বসেছে। অষ্টম গেমে নিজের সার্ভিসে ৩-৪ গেমে, ০-৪০ পয়েন্টে পিছিয়ে। কিন্তু জকোভিচ তিনটে ব্রেক পয়েন্টের একটাও কাজে লাগাতে পারেনি। নইলে তো খেলা ওখানেই কার্যত সাঙ্গ হয়ে যাওয়ার কথা, যদি জকোভিচ ৫-৩ এগিয়ে নিজে সার্ভিস করত। উল্টে নাদাল ৪-৪ করে শেষ পর্যন্ত সেটটা টাইব্রেকারে নিয়ে গিয়ে, সেখানে প্রথম পয়েন্টটা অবিশ্বাস্য খেলে জেতার আত্মবিশ্বাসকে সম্বল করে সেটটাই নিয়ে নেয়। বর্গ বা ফেডেরার হলে কি নাদালকে এই সুযোগ দিত? কোনও হাড্ডাহাড্ডি গ্র্যান্ড স্লাম ফাইনালের শেষের দিকে, মহাগুরুত্বপূর্ণ বিগ পয়েন্টে বিশ্বের এক নম্বরের থেকে কি এ রকম নেতিবাচক পারফরম্যান্স প্রত্যাশিত?
পঞ্চম সেটে জকোভিচকে আমার কোর্টে একদম দম ফুরিয়ে যাওয়া খেলোয়াড় লেগেছে। কিন্তু প্রায় ছয় ঘণ্টার ম্যাচটার যদি কোনও অংশকে আমি মনের ভেতর রেখে দিই তো সেটা হল, তুমুল ক্লান্তিতে প্রায় ভেঙে পড়া শরীর নিয়েও জকোভিচের ম্যাচ বার করে নেওয়ার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা! চূড়ান্ত সেটে ২-৪ গেমে পিছিয়ে পড়েও শরীরের শেষ ঘামের বিন্দুটাও ঝরিয়ে, কোর্টে নিজের অন্তিম শক্তি প্রয়োগ করে জকোভিচ ৫-৫ করে। তার পর নাদালের ‘আনফোর্সড এরর’-এর সুবাদে ওর সার্ভিস ব্রেক করে ৭-৫-এ গেম-সেট-ম্যাচ জিতে নেয় জকোভিচ। ওই সময় নাদাল এমন কয়েকটা ভুল শট মেরেছে যা দেখে পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম, ওর মতো সুপার হিউম্যান-ও টেনশনে ভুগছে। তুমুল চাপ অনুভব করছে। আসলে সুপার হিউম্যান-ও এক জন মানুষই। সে-ও কোনও ভাবে টেনশনে আক্রান্ত হলে গড়পড়তা সাধারণ প্লেয়ারের মতোই ভুল করে বসে। |
সুপার হিউম্যান-এর কথা বলছিলাম। জকোভিচ বা নাদাল আমার চোখে টেনিসের সুপার হিউম্যান। ক্লাসিক প্লেয়ার নয়। সে কারণে এখনই ওদের দু’জনের কাউকে সর্বকালের অন্যতম সেরা বলতে আমার দ্বিধা আছে। সে নাদাল যতই ১০টা গ্র্যান্ড স্লাম জিতুক। বা ফেডেরারেরও আগে চারটে সারফেসেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে ‘কেরিয়ার গ্র্যান্ড স্লাম’ করে দেখাক। কিংবা জকোভিচও যতই শেষ পাঁচটা গ্র্যান্ড স্লামের মধ্যে চারটেই জিতুক। তবে ওদের বয়স ২৪-২৫-এর মধ্যে। এখনও অনেক দিন খেলবে। সুতরাং ওদের সর্বকালের সেরা বলার জন্য এখনও অনেক সময় পড়ে আছে।
তবে জকোভিচ-নাদালদের পক্ষেও বলার মতো প্রচুর জিনিস আছে ওদের টেনিসে। ভাবুন তো, এ দিন ৩৫৩ মিনিট ধরে ওদের এক-এক জন কত মাইল কোর্টে দৌড়েছে, প্রায় স্প্রিন্টারের গতিতে? কত-কতগুলো ২০-২৫টা শটের র্যালি খেলেছে দু’জনে নিজেদের মধ্যে মেলবোর্নের ওই তিরিশ-একত্রিশ ডিগ্রি গরমে? অন্য আর কোনও খেলায় টেনিসের মতো এত ভয়ঙ্কর শক্তি লাগে না। এত বেশি দৌড়ঝাঁপ করতে হয় না ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে। ফুটবল নব্বই মিনিটের খেলা। তার মধ্যে পঁয়তাল্লিশ মিনিটও বল পায়ে ফুটবলারকে স্প্রিন্ট টানতে হয় কি না সন্দেহ। সেখানে টেনিসে প্রতিটা পয়েন্টের জন্য এক জন প্লেয়ারকে প্রত্যেক বার বল ‘হিট’ করতে ৩০ মিটার পর্যন্তও স্প্রিন্ট টানতে হয়। এবং তা-ও অলিম্পিকে একশো মিটার দৌড়ের গতিতে। এ দিনের ফাইনালে এ রকম অসাধারণ ছবিও কিন্তু অসংখ্য বার দেখা গিয়েছে। দেড় দিনের মধ্যে দু’টো নিংড়ে নেওয়া ম্যারাথন পাঁচ সেট ম্যাচ জেতার অবিশ্বাস্য শক্তি দেখাল জকোভিচ।
আসলে টেনিস খেলাটাই এখন অনেক পাল্টে গিয়েছে। আমাদের প্রজন্মের কাঠের র্যাকেট, ছোট বল, ন্যাচারাল সারফেস...সব ওলোটপালট হয়ে গিয়েছে। অত্যাধুনিক গ্র্যাফাইট র্যাকেট। নতুন চরিত্রের বল। সিন্থেটিক কোর্ট। সর্বোচ্চ পর্যায়ের স্পোর্টস মেডিসিনের সুযোগসুবিধা। ম্যাসাজ। ডায়েট। ফিজিক্যাল কন্ডিশনিং। জিম। যোগাভ্যাস সব মিলিয়ে টেনিস-কারখানা থেকে এক-একটা শীর্ষ পর্যায়ের টেনিস-মেশিন হিসেবে বেরিয়ে আসছে এই প্রজন্মের খেলোয়াড়রা। যত দিন যাবে, তত বেশি করে ‘জকোভিচ’দের সার্কিটে দেখা যাবে। কমে যাবে ‘ফেডেরার’দের সংখ্যা। টাচ কমবে। বাড়বে শক্তি, ফিটনেস লেভেল। এনডিওরেন্স।
রবিবারের রড লেভার এরিনার ৩৫৩ মিনিট সেটাই বুঝিয়ে দিল! |
|
দীর্ঘতম গ্র্যান্ড
স্লাম লড়াই |
১১ ঘণ্টা ৫ মিনিট
২০১০ সালে উইম্বলডন প্রথম রাউন্ডে জন ইসনার
হারান নিকোলাস মাহুত-কে। |
৬ ঘণ্টা ৩৩ মিনিট
২০০৪ সালে ফরাসি ওপেনের প্রথম রাউন্ডে ফাব্রিস সান্তোর
হারান আর্নোদ ক্লেমেন্ট-কে। |
৫ ঘণ্টা ৫৩ মিনিট
২০১২ সালে অস্ট্রেলীয়
ওপেন ফাইনালে নোভাক জকোভিচ
হারান রাফায়েল নাদাল-কে। কোনও গ্র্যান্ড স্লাম ফাইনাল এতক্ষণ চলেনি। |
৫ ঘণ্টা ২৬ মিনিট
১৯৯২ সালের যুক্তরাষ্ট্র
ওপেন সেমিফাইনালে স্টেফান এডবার্গ
হারান মাইকেল চ্যাং-কে। |
৪ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট
২০০৮ সালের উইম্বলডন
ফাইনালে রাফায়েল নাদাল
হারান রজার ফেডেরার-কে। |
|