|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
বিভ্রান্তির পরিচায়ক |
সরকারি পরিবহণের দুর্দশা ঘুচাইতে পূর্বসূরির মতো ভর্তুকি ব্যবস্থাই বহাল রাখিবার সিদ্ধান্ত লইয়াছে ‘পরিবর্তন’-এর সরকার। বলা হইতেছে, আপাতত ছয় মাস। কিন্তু ছয় মাস দীর্ঘ সময়। মাঝখানে কিছু দিন ভর্তুকি বন্ধ করিয়া দেওয়া কিংবা হ্রাস করা এবং ‘অবৈধ’ নিয়োগ বাতিল করা লইয়া কিছু লম্ফঝম্প হইয়াছিল। শাসনক্ষমতার শীর্ষ পদ হইতে রকমারি সতর্কবাণী ও হুঁশিয়ারিও উচ্চারিত হইয়াছিল। কিন্তু এক পরিবহণ কর্মীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া সব সরকারি প্রস্তাব ও নীতির ধারা রাতারাতি বদলাইয়া দিয়াছে। সর্বোচ্চ সরকারি স্তরেই সিদ্ধান্ত হইয়াছে, কোনও অবৈধ নিয়োগ বাতিল হইবে না, তেমন নিয়োগের বেতনও বকেয়া থাকিবে না, ভর্তুকি আগের মতোই চলিবে এবং বিভিন্ন নিগমের কর্তারা কর্মচারীদের সহিত আলোচনা করিয়া আগামী পক্ষ কালের মধ্যে পরিবহণের হাল ফিরাইবার দাওয়াই বাতলাইয়া দিবেন। অর্থাৎ রাজ্যের পরিবহণ ব্যবস্থাটি যেখানে ছিল, সেখানেই থাকিয়া গেল--ন যযৌ, ন তস্থৌ।
রাজ্যের পরিবহণের মূল সমস্যা কী? এক, পর্যাপ্ত সংখ্যায় বাস না-থাকা। দুই, বাস-পিছু কর্মীর সংখ্যাধিক্য। তিন, যথাযথ হারে বাসভাড়া ধার্য না করা। নূতন বাস কেনা, পুরানো বাসগুলির রক্ষণাবেক্ষণ, অলাভজনক রুটেও বাস চালানো এই সবের জন্য চাই পর্যাপ্ত তহবিল, যাহা ভাড়া বৃদ্ধি করিয়াই সংগ্রহ করা সম্ভব। কোনও মতেই ভাড়া বাড়াইব না, এই অঙ্গীকারের অনিবার্য পরিণতিই হইল পরিবহণ-ব্যবস্থাটিকে রুগ্ণ করিয়া দেওয়া। প্রসঙ্গত, তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত রেল মন্ত্রকেও একই অঙ্গীকার সমগ্র রেল-চলাচল ব্যবস্থা এবং যাত্রি-নিরাপত্তার বন্দোবস্তটিকেই বানচাল করিয়া দিয়াছে। অঙ্গীকারটি যদি শীর্ষ প্রশাসনিক স্তরের অনমনীয় জেদে পরিণত হয়, তবে ঈশ্বরও রাজ্যের পরিবহণের হাল ফিরাইতে পারিবেন না। দ্বিতীয় সমস্যাটি হইল বাড়তি কর্মীর সমস্যা। রাজ্য-পরিবহণের হাল ফিরাইতে ঋণ-অনুদানের পসরা লইয়া হাজির ডিএফআইডি বহু কাল আগেই কর্মী-সঙ্কোচনের প্রস্তাব দিয়াছিল। দেশের অন্যান্য রাজ্যের তুলনাতেও পশ্চিমবঙ্গে বাস-পিছু কর্মী অনুপাত অস্বাভাবিক রকমের বেশি। অনেক কর্মচারীরই কোনও কাজ নাই, কিন্তু নিয়মিত বেতন-ভাতা আছে, বোনাস আছে। এখন আবার শুনা যাইতেছে, অনেক কর্মী নাকি স্বাস্থ্যের কারণে পরিবহণ-কর্মী হওয়ারই অযোগ্য এবং এমন অদক্ষ কর্মীর সংখ্যা বিভিন্ন নিগমে প্রায় সাড়ে ছয়শো। এই কর্মচারীদের বসাইয়া রাখিয়া বেতন গোনা অর্থহীন। সরকারি পরিবহণ দফতর কোনও মানবতাবাদী লঙ্গরখানা হইতে পারে না। আসল কথা, সরকারি দফতরের অব্যবস্থা দূর করিতে হইলে সুস্পষ্ট নীতি চাই। এক-এক বার এক-এক রকম কথা বলিলে তাহাতে নীতিহীনতা বা বিভ্রান্তিই ধরা পড়ে। দেখিতে দেখিতে নূতন সরকারও আর তত নূতন নাই, আট মাস কাটিয়া গিয়াছে। এবং আট মাস খুব কম সময় কিন্তু নয়। অথচ সরকারের বহু গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকেরই কাজকর্মের দশা দিশাহীনতার পরিচয়বাহী। পরিবহণ সমস্যার সুরাহার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী যে-পনেরো দিনের সময়সীমা ধার্য করিয়াছেন, তাহাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রশ্ন হইল, আট মাসে যাহা হইতে পারিল না, পনেরো দিনে তাহা কেমন করিয়া হইবে? রাজ্যের স্বাস্থ্যচিত্রও তো একই রকম দুর্গতিগ্রস্ত। হাসপাতালে আকস্মিক সফরের চমক ম্লান হইয়া যাওয়ার পর সরকারি হাসপাতাল আবার কুকুর-বিড়াল, বারান্দায় প্রসব, ব্যাপক শিশুমৃত্যুর অরাজকতায় নিমজ্জিত। কৃষিমন্ত্রীর প্রগল্ভতায় ঋণগ্রস্ত চাষির আত্মহত্যা কিংবা ধান বিক্রয়ে অক্ষম চাষির ক্ষোভও প্রশমিত হইতেছে না। সব মিলাইয়া ‘পরিবর্তন’-এর লক্ষণগুলি কিন্তু বিশেষ ইতিবাচক নয়। |
|
|
|
|
|