প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর উপস্থিতিতে সরকার ও দল পরিচালনা নিয়ে নেতৃত্বকে জেলা সম্মেলনে তুলোধোনা করলেন উত্তর ২৪ পরগনা জেলার প্রতিনিধিরা। অন্য জেলার সম্মেলনে সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্ব সমালোচনার মুখে পড়লেও বুদ্ধ-বিমানকে এমন কড়া কথা হজম করতে হয়নি। সমালোচিত হয়েছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এবং প্রাক্তন মন্ত্রী গৌতম দেবও। প্রতিনিধিদের ক্ষোভ সামলাতে সিপিএমের প্রায় গোটা রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী শনিবার দমদমে জেলা সম্মেলনে উপস্থিত হয়। আজ, রবিবার সম্মেলনের শেষ দিন বিমানবাবু কী জবাব দেন, তাই দেখার।
প্রতিনিধিদের মতে, সরকার ও দল পরিচালনায় একের পর এক ‘ভুল নীতি’ গ্রহণের ফলেই সিপিএমের এই বিপর্যয়। কিন্তু দলের নেতারা বিপর্যয়ের কারণ মূলত নিচুতলার নেতা ও কর্মীদের উপর চাপিয়ে ‘দায়মুক্ত’ হতে চাইছেন। দলের একাংশের পচনকে ‘বিষফোঁড়া’র সঙ্গে তুলনা করে প্রতিনিধিদের প্রশ্ন, ৩৪ বছর সরকারে থাকার সময়ে কেন সেই ‘বিষফোঁড়া’ অস্ত্রোপচার করা হয়নি? প্রতিনিধিদের প্রশ্ন, এখন ‘শুদ্ধকরণ’ নিয়ে এত কথা বলা হচ্ছে। |
কিন্তু বছরের পর পর দল ভোটে জেতার সময় ‘অভিযুক্ত’ নেতাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? তাঁদের একাংশের আরও অভিযোগ, একাধিক নেতার বিরুদ্ধে বছরের পর বছর কমিশন চলা সত্ত্বেও নেতৃত্ব কোনও ব্যবস্থা নেননি। অভিযুক্ত নেতাদের সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠতা’র সুবাদেই উপরতলার নেতারা ব্যবস্থা গ্রহণে বাধা দিয়েছেন।
বিধানসভা ভোটে হারের পর আলিমুদ্দিনের নেতারা কেন বার বার নিচুতলার কর্মীদের কার্যকলাপ নিয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা করছেন তা নিয়েও সম্মেলনে প্রশ্ন ওঠে। ‘ক্ষুব্ধ’ প্রতিনিধিদের বক্তব্য, এ ভাবে প্রশ্ন তুলে লোকাল বা জোনাল কমিটির সদস্যদের জনসমক্ষে ‘হেয়’ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছে আলিমুদ্দিন। কিন্তু তা করতে গিয়ে যে তাঁরা কার্যত তৃণমূলের রাজনৈতিক সুবিধা করে দিচ্ছেন, তা খেয়াল রাখছেন না। ক্ষুব্ধ প্রতিনিধিরা বলেন, আলিমুদ্দিনের নেতাদের কিছু বলার থাকলে তাঁরা তা দলের মধ্যে বলতে পারেন। তার জন্য নানা মঞ্চ রয়েছে। সেই মঞ্চগুলি ব্যবহার না-করে কেন প্রকাশ্যে দোষারোপ করা হচ্ছে? ওই ভাবে নিচুতলার নেতা-কর্মীদের নিয়ে জনসমক্ষে প্রশ্ন তুলে রাজ্য নেতারা নিজেদের ‘পরিচ্ছন্ন’ রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু রাজ্য নেতাদেরই অনেকের কাজকর্ম নিয়ে সাধারণ মানুষের নানা প্রশ্ন আছে।
বুদ্ধ-বিমান-গৌতম দেবরা প্রকাশ্যে দলের কিছু নেতা-কর্মীর ‘অ-কমিউনিস্ট সুলভ আচরণ, ঔদ্ধত্য ও দুর্নীতি’ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। বিধানসভা ভোটের আগে থেকেই গৌতমবাবু ওই কথা প্রকাশ্যে বলা শুরু করেছিলেন। দমদমের জেলা সম্মেলনে বিমানবাবুও একই কথার প্রতিধ্বনি করেছেন। প্রতিনিধিদের বক্তব্য, ভোট করতে নেতা-কর্মী লাগে। কিছু জনসমক্ষে দলের নেতার নিন্দা করলে সামগ্রিক ভাবে দলেরই ভাবমূর্তির ক্ষতি হয়। নেতারা তা ভাবছেন না। নাম না-করে বিমানবাবুর অসংলগ্ল কথা (কংগ্রেস ও তৃণমূল সম্পর্কে) বা হুগলির অনিল বসুর মন্তব্য (মমতা সম্পর্কে) তুলে প্রতিনিধিদের প্রশ্ন, কেন দলের কোনও মুখপাত্র নেই? এক একজন নেতা এক একরকম কথা বলছেন। প্রায় প্রতিদিন টিভি-র আলোচনায় দলের যে সব নেতা মুখ দেখান, তাঁরা কীসের ভিত্তিতে মনোনীত হন, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
সমালোচনার হাত থেকে রেহাই পাননি বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রও। একদা ‘দলের সম্পদ’ প্রাক্তন মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষকে কেন বিরোধী দলনেতা এক দিনও জেলে দেখতে গেলেন না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন প্রতিনিধিরা। প্রশ্ন তোলেন, সুশান্তবাবু দীর্ঘ দিন জেলে থাকলেও তা নিয়ে নেতৃত্বের কোনও হেলদোল নেই বলেও অভিযোগ ওঠে। |
প্রশ্ন ওঠে বামফ্রন্ট সরকারের কাজ নিয়েও। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবু নিজে সংখ্যালঘু দফতরের দায়িত্বে থাকা সত্ত্বেও কেন ওবিসি সংখ্যালঘুদের সংরক্ষণ আরও আগে রাজ্য সরকার চালু করেনি, ষষ্ঠ বামফ্রন্টের সময় থেকেই স্বাস্থ্য দফতর নিয়ে বার বার অভিযোগ ওঠা সত্ত্বেও স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যবাবু কী করেছিলেন, পঞ্চায়েতের কাজে দীর্ঘসূত্রিতা, প্রয়োজনীয় সার্টিফিকেট না-পাওয়া, সরকারি অফিসে গিয়ে সাধারণ মানুষের হয়রানি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ব্যর্থতা নিয়ে প্রত্যেক জেলা সম্মেলনেই প্রশ্ন উঠেছে। উত্তর ২৪ পরগনার প্রতিনিধিরা এক ধাপ এগিয়ে প্রশ্ন তোলেন, রাজ্য সরকার কেন জোর করে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সিঙ্গুরের অবস্থান থেকে তুলে দেয়নি। প্রতিনিধিদের বক্তব্য, ১৯৯৩ সালে যুব কংগ্রেস নেত্রী মমতার মহাকরণ অবরোধ অভিযানে গুলি চালিয়েছিল জ্যোতি বসুর পুলিশ। ১৩ জন কংগ্রেসকর্মী নিহত হয়েছিলেন। কিন্তু জ্যোতিবাবু পিছু হঠেননি। সেই উদাহরণ সত্ত্বেও কেন বুদ্ধবাবু পিছু হটলেন? মমতার ‘মতুয়া-রাজনীতি’র পাল্টা করতে গিয়ে বিধানসভা ভোটের আগে হঠাৎ করে মতুয়া সম্প্রদায়কে নিয়ে প্রাক্তন মন্ত্রী গৌতমবাবুর কার্যকলাপ (ঠাকুরনগরের কাছে ও রাজারহাট উপনগরীতে জমি ও গৃহনির্মাণ) তা-ও মানুষ ভাল ভাবে নেননি বলে প্রতিনিধিদের একাংশের বক্তব্য। তাঁরা বলেন, ওই ঘটনার ফলে মতুয়াদের মধ্যে সিপিএমের বিরুদ্ধে প্রচারে সুবিধা হয়েছিল তৃণমূলের।
আগামী দিনে সংগঠন ‘শক্তিশালী’ করা নিয়েও আলোচনা করেন প্রতিনিধিরা। তাঁদের মতে, বিভিন্ন এলাকায় তৃণমূলের ‘সন্ত্রাস’ ও সরকার পরিচালনায় ‘ব্যর্থতা’ নিয়ে মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ সৃষ্টি হচ্ছে, তা কাজে লাগাতে হবে। প্রতিনিধিদের আরও দাবি, সিপিএমের বিভিন্ন গণ-সংগঠন থেকে নতুন করে এখন আর কেউ তৃণমূলে যোগ দিচ্ছে না। উল্টে ধানের দাম পড়ে যাওয়া নিয়ে চাষিদের মধ্যে ‘ক্ষোভে’র সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিনিধিদের বক্তব্য, সেই ক্ষোভ কাজে লাগাতে হবে। |