চাষি থেকে রাজ্য সরকারসহায়ক মূল্যে ধান কেনার এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে যে চালকলের, কেতুগ্রামের চাষি ভূতনাথ পালের আত্মহত্যা সেই ‘ভূমিকা’ নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। বাড়ির লোকের ক্ষোভ, কাটোয়ার যে চালকলে গ্রামের কয়েকজনের সঙ্গে মিলে ভূতনাথবাবু ধান বিক্রি করেন, সেখান থেকে তাঁদের বলে দেওয়া হয়েছিল, পরে ‘চেক’ দেওয়া হবে। শনিবার পর্যন্ত টাকা ভূতনাথবাবুর পরিবার হাতে পায়নি। টাকা হাতে পেলে ‘এমন হত না’ বলে দাবি মৃতের স্ত্রী অত্যুন্তি পালের। যদিও বর্ধমান জেলা চালকল মালিকেরা অভিযোগের আঙুল তুলেছেন সরকারের দিকে। তাঁদের বক্তব্য, সরকারের থেকে টাকা না পাওয়াতেই এই ‘পরিস্থিতি’।
খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “টাকা পায়নি বলে চালকল চাষিকে টাকা দিতে পারছে না, এই অভিযোগ অসত্য। বর্ধমান জেলা থেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কিছু মিথ্যা খবর ছড়ানো হচ্ছে।” অর্থ দফতরের এক শীর্ষ-কর্তারও দাবি, রাজ্যের যে নিগমগুলি কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনে, তাদের টাকা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতেই ট্রেজারি থেকে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। চলতি সপ্তাহে একটি নিগমকে কয়েক কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে ধান কেনার জন্য। কিন্তু টাকা দেওয়া হচ্ছে না এই অভিযোগ ঠিক নয়। ওই কর্তা মেনেছেন, “অনেক সময় নানা কারণে ব্যাঙ্ক, সরকারি অফিস ছুটি থাকছে। তাই ট্রেজারি থেকে চালকল মালিকদের কাছে টাকা পৌঁছতে সময় লাগছে।” সিপিএমের বর্ধমান জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, কৃষকসভার বর্ধমান জেলা সম্পাদক আব্দুর রজ্জাক মোল্লার অভিযোগ, “রাজ্যের ভ্রান্ত নীতি এর জন্য দায়ী। সরকারের হাতে টাকা নেই। অথচ, তারা ধান কেনার স্বপ্ন দেখাচ্ছে চাষিদের!”
আমন-বোরো-আউশ মিলিয়ে রাজ্যে গড়ে প্রায় ১ কোটি ৫০ লক্ষ টন ধান উৎপন্ন হয়। রাজ্য সরকার সহায়ক মূল্যে ধান কিনবে ২০ লক্ষ টন। ধান কেনায় ভূমিকা থাকে চালকলের। ধান কেনা নিয়ে দিন কয়েক আগে বৈঠক হয় কাটোয়া মহকুমায় (ভূতনাথবাবুও এই এলাকার বাসিন্দা ছিলেন)। বৈঠকে কেতুগ্রাম, কাটোয়া ও মঙ্গলকোটের ৩ বিধায়ক, চালকল মালিক ও প্রশাসনের কর্তাদের উপস্থিতিতে ঠিক হয়, চাষিদের পঞ্চায়েত থেকে শংসাপত্র (তিনি যে প্রকৃত চাষি এই মর্মে) নিতে হবে। সেই শংসাপত্র ব্লক অফিসে দেখিয়ে মাথাপিছু সর্বোচ্চ ৩০ বস্তা (প্রতি বস্তা ৬০ কেজির) ধানের জন্য ‘টোকেন’ সংগ্রহ করতে হবে। সেই ‘টোকেন’ চালকলে দেখালে, ধান বিক্রি করা যাবে। ধানের দাম বাবদ চাষিদের ‘চেক’ পাওয়ার কথা তখনই। কিন্তু চাষিদের অভিযোগ, চালকল মালিকেরা ‘চেক’ দিতে দেরি করলেও, যখন চেক দিচ্ছেন, তাতে তারিখ থাকছে ধান বিক্রির দিনের। কাটোয়ার যে চালকলে ভূতনাথবাবু ২০ জানুয়ারি ধান বিক্রি করেছিলেন, তার বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ আত্মঘাতী চাষির পরিবারের। ওই চালকলের ম্যানেজার অরূপ ঘোষের বক্তব্য, “৬ জানুয়ারি থেকে সরকারি টাকা পাইনি। তাই সঙ্গে সঙ্গে চাষিদের দাম বাবদ চেক দিতে পারছি না।” ‘বেঙ্গল রাইসমিল অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি দেবনাথ মণ্ডল বলেন, “ধানের সঙ্গে অনেকটা খড়-কুটো, মাটি মিশে থাকে। সেটা বাছাই করে চালকল মালিকেরা ধানের ওজনের ভিত্তিতে দাম মেটান। অনেক সময় চাষিদের একাংশ অনুরোধ করেন, ঝাড়াই-বাছাই না করে সব সমেত ধান কিনতে। দু’দিন বাদে চেক নিতেও আপত্তি থাকে না। পুরোটাই হয় বোঝাপড়ার ভিত্তিতে।”
তবে বড়ঞা ও সাগরদিঘিতে সম্প্রতি চালকলের দেওয়া চেক ‘বাউন্স’ও করার কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তা বলছেন, “ধান কেনার দিনের অনেক পরে চেক দিলেও অনেক চাল-কল কর্তৃপক্ষ, তাতে ধান কেনার দিন বসিয়ে দিচ্ছেযাতে চেক বাউন্সের দায়ে পড়তে না হয় তাদের।” এই ‘তত্ত্ব’ মানেননি চালকল মালিকেরা। বর্ধমান জেলা চালকল মালিক সমিতির কাটোয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত অমর কুণ্ডুর ব্যাখ্যা, “চাষিদের থেকে আমরা ধান কিনব। সেই ধান চাল করে সরকারি গুদামে পৌঁছে দেব। ৭ দিনের মধ্যে সরকারি টাকা পাব। এখনও সরকারি অনেক গুদামে আগের চাল রয়েছে। আমরা চাল ঢোকাতে পারছি না। তাই টাকাও পাচ্ছি না।” বর্ধমানের মতো রাজ্যে ধানের আর এক বড় জোগানদার হুগলি জেলা। সেখানে চালকল মালিকেরা চাষিদের থেকে ধান কেনা বন্ধ করেছেন। জেলার ১১৫টি চালকলের মালিকেরা প্রশাসনকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, তাঁরা যে পরিমাণ ধান কিনেছেন, তা বিক্রি না হওয়ায় গুদামগুলিতে ‘ঠাঁই নেই’ পরিস্থিতি। ৯ ডিসেম্বর চালকল মালিকরা বলাগড়ে ধান কেনার শেষ শিবির করেন। এর পরে আর কোথাও ওই শিবির হয়নি।
এই পরিস্থিতিতে বিপন্ন বোধ করছেন পুড়শুড়ার চাষি প্রেমেন্দ্র হাজরার মতো অনেকে। তাঁরা জানান, খোলাবাজারে ধান ব্যবসায়ীরা এখন বস্তাপিছু (৬০ কেজি) ৫০০-৫২০ টাকা দাম দিচ্ছেন। প্রেমেন্দ্রবাবু বলেন, “বস্তাপিছু অন্তত ৭০০ টাকা না পেলে লোকসান হবে। আবার কবে সরকার ধান কেনে, সে দিকে তাকিয়ে আছি।” |