এ বার ‘পরিবর্তন’ সিপিএম-এ।
এপ্রিলে পার্টি কংগ্রেসের মুখে একবিংশ শতাব্দীর দল হিসাবে নিজেদের মতাদর্শগত অবস্থানে অনেকটাই বদল আনতে চলেছেন সিপিএম শীর্ষ নেতৃত্ব। চলতি সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে একটি মতাদর্শগত দলিল তৈরি করছে সিপিএম। এমনকী সর্বস্তরের মতামত সংগ্রহের জন্য সেটির খসড়া সাধারণ মানুষের কাছেও প্রকাশ করে দেওয়া হবে। রাশিয়া-চিনের মডেল ছেড়ে সম্পূর্ণ ভারতীয় পথে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের রাস্তা খোঁজা
হয়েছে এই নতুন দলিলে। আর তা নিয়েই এখন দলের মধ্যে
ঝড় উঠেছে।
এ বারের দলিলে মতাদর্শগত প্রশ্নে বেশ কিছু বড় মাপের পরিবর্তন আনছে সিপিএম। প্রথমত, প্রায় এক যুগ আগে মতাদর্শগত দলিলে বলা হয়েছিল, বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই সমাজতন্ত্রের বিকাশের পথে এগোতে হবে। নতুন দলিলে সেই ‘এগোনো’র কাজকে দ্রুত রূপ দেওয়াই আশু লক্ষ্য হিসেবে বেছেছেন সিপিএম নেতৃত্ব। দ্বিতীয়ত আগে দলের লক্ষ্য ছিল, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণির একনায়কতন্ত্রকে কায়েম করা। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর ‘একনায়কতন্ত্র’ শব্দটি দল বাদ দিয়েছিল। এ বার আরও স্পষ্ট ভাবে সাবেক রুশ এবং চিন দু’টি মডেলকেই বাতিল করে দিয়ে বলা হচ্ছে, ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাই সবথেকে বেশি জরুরি। সমাজতন্ত্রের সঙ্গে গণতন্ত্রের কোনও বিরোধ নেই’। ‘সর্বহারার একনায়কতন্ত্রে’ শুধু মাত্র ‘সর্বহারা শ্রেণি’র হাতেই ক্ষমতার কথা বলা হয়। কিন্তু সিপিএম নেতৃত্বের বক্তব্য, ভারতের বাস্তব পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে একটা শ্রেণি নয়, নানা শ্রেণির মধ্যে সমন্বয় রক্ষা করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয়। তাই ‘সর্বহারার একনায়কতন্ত্রে’র বিষয়টাকেই আপাতত মতাদর্শগত পথনির্দেশিকা থেকে বাদ দেওয়ার পথে এগোচ্ছেন সিপিএম নেতৃত্ব। |
বাতিল হচ্ছে রাশিয়া-চিনের তত্ত্ব |
 |
তিন
পরিবর্তন |
• একদলীয় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তে বহুদলীয়
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমাজতন্ত্রকে রূপ দেওয়া। |
• ‘সর্বহারার একনায়কতন্ত্র’ বাদ দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জোর। |
• বাজার অর্থনীতিকে গ্রহণ করা, যেখানে সরকারি
ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে কাজ হবে। |
|
তৃতীয়ত, বাজার অর্থনীতিকে গ্রহণ করা। সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের কথাই বলা হয়। এখন সিপিএম বলছে, খোলাবাজার অর্থনীতির মধ্যেই যে হেতু দল কাজ করতে বাধ্য, তাই বাজারকে স্বীকার করে যৌথ উদ্যোগে এগোতে হবে। অর্থাৎ সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে কাজ করতে হবে।
বলশেভিক বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়নে ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ করে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আনা হয়েছিল। কিন্তু তাতেও এক নতুন ধরনের অভিজাত আমলাতন্ত্র গড়ে উঠেছিল। শ্রেণি বৈষম্য তো ঘোচেইনি, উল্টে সোভিয়েত ইউনিয়নই তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল। ১৯৬৪ সালে সিপিএম গঠনের সময় মতাদর্শগত বিতর্ক হয়েছিল বিশ্ব সমাজতন্ত্র নিয়ে। তখন চিন ও সোভিয়েত মডেল নিয়ে বিরাট বিতর্ক হয়। ‘নতুন যুগে’র কথা ঘোষণা করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ষাট সালের বিবৃতিতে বলেছিল যে, নভেম্বর বিপ্লবের মাধ্যমে ‘ধনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রে শান্তিপূর্ণ উত্তরণ সম্ভব হচ্ছে’। কিন্তু চিনা কমিউনিস্ট পার্টি সোভিয়েতের এই তত্ত্ব মানতে রাজি ছিল না। এ নিয়ে দু’দেশের মধ্যে মতাদর্শগত বিরোধ তীব্র হয়। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যেও একাংশ সোভিয়েতের তত্ত্ব মানতে রাজি ছিল না। আর চিন-সোভিয়েত সেই বিরোধের প্রেক্ষাপটেই ভারতেও কমিউনিস্ট পার্টি দু’টুকরো হয়।
এ বারের নয়া দলিল নিয়ে দলের মধ্যেই বিতর্ক শুরু হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, সে দিন ক্রুশ্চেভের ‘শান্তিপূর্ণ ভাবে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের’ পথকে সংশোধনবাদ বলা হয়েছিল। আর আজ নতুন মতাদর্শগত দলিলে যা বলা হচ্ছে, সেটার সঙ্গে ক্রুশ্চেভের সংশোধনবাদের ফারাক কোথায়? প্রশ্ন উঠেছে, সে দিন তোগলিয়াত্তির ‘ইউরো কমিউনিজমকে’ প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব বলা হলেও আজ যে সমাজতন্ত্রের মডেল তুলে ধরা হচ্ছে, সেটার সঙ্গে ইউরো কমিউনিজমের পার্থক্য কোথায়?
সিপিএম রুশ এবং চিন মডেল বাতিল করলেও সাম্প্রতিক কালে লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের সমাজতান্ত্রিক সাফল্যকে অনুসরণ করতে আগ্রহী। কিন্তু ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ ১৯৭৩ সালে কলকাতায় এক সেমিনারে বলেছিলেন, চিলি আর ভারতের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এক রকম হতে পারে না। কারণ সামরিক পথে নয়, ভারতে এগোতে হবে গণতান্ত্রিক পথে।
সিপিএম সূত্র বলছে, সম্প্রতি চিনের দলীয় মহাঅধিবেশনে হু জিনতাও বারবার বলেছেন, চিন মার্ক্সবাদ অনুসরণ করতে চায়, কিন্তু চিনা বৈশিষ্ট্য নিয়ে। সিপিএমের মধ্যেও এ বার প্রবল ভাবে দাবি উঠেছে যে, আর আন্তর্জাতিক মডেল নয়, ভারতীয় বৈশিষ্টের ওপর দাঁড়িয়েই সমাজতান্ত্রিক পথে এগোনো দরকার। আর তাই কমিন্টার্নের শাখা ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’ থেকে এ বার ‘ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি’ হয়ে ওঠার সময় এসেছে। কিন্তু এ নিয়েও দলের একাংশের মধ্যে সংশয় তৈরি হয়েছে। চিনা কমিউনিস্ট পার্টি যে ভাবে বলতে পারে, ‘চিনা বৈশিষ্ট্য সহকারে মার্ক্সবাদ’, ভারতে কি তা সম্ভব? কারণ ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আগাগোড়াই অভিযোগ যে, তাঁরা কোনও দিন সে ভাবে ভারতীয় মননকে গুরুত্ব দেননি। এ কথা মাথায় রেখেই এখন ভারতীয় ভাবধারাকে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়ার পথে এগোচ্ছে দল। তাই এ বারের দলিলে শুধু শ্রেণি চেতনা নয়, অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে প্রান্তিক সত্তার প্রশ্নটিকে। বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ যখন ‘মণ্ডল আন্দোলন’ করেছিলেন, তখনও জাত নয়, শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গিকেই মূলধন করে এগোতে চেয়েছিল সিপিএম। কিন্তু এখন দলীয় নেতৃত্ব বুঝতে পারছেন, প্রান্তিক সত্তা বিষয়টি শুধু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে নয়, মতাদর্শগত ক্ষেত্রেও বিশেষ ভাবে আলোচনার সময় এসেছে। দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্নে এই বিপুল পরিবর্তন কি মতাদর্শগত ক্ষেত্রে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যাওয়া? সিপিএম নেতৃত্ব বলছেন, এটা মার্ক্সবাদের সংশোধন নয়, সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া। কিন্তু সর্বহারার একনায়কতন্ত্র-সহ নানা প্রশ্নে যে ভাবে একটি কমিউনিস্ট দলের তাত্ত্বিক সৌধকেই ভেঙে দেওয়া হচ্ছে, তাতে কি সম্পূর্ণ নতুন এক কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম হয় না! |