স্বামীজির ‘শিক্ষে’ ছড়িয়ে দিতেই শিকাগোয় প্রণব
সুবিশাল এক ভবন। তখন নাম ছিল, ‘আর্ট অফ প্যালেস’। ১৮৯৩-এর ১১ সেপ্টেম্বর সেখানেই বক্তৃতা করে গোটা আমেরিকার হৃদয় জয় করেছিলেন এক বাঙালি। ঘোষণা করেছিলেন, ‘‘আমি হচ্ছি ইতিহাসে প্রথম হিন্দু সন্ন্যাসী, যে সমুদ্র পেরিয়ে এই পাশ্চাত্য দেশে এসেছে।’’
১১৯ বছরের পুরনো স্মৃতিকে শ্রদ্ধা জানাতে আজ সেই ইতিহাস-নগরীতে পৌঁছলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। বিবেকানন্দের সার্ধশতবর্ষের স্মরণে নয়াদিল্লির সঙ্গে এই প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে জোট বাঁধল শিকাগো।
বিবেকানন্দ সম্পর্কে অসুস্থ শ্রীরামকৃষ্ণ এক বার কাগজ-পেনসিলে লিখে রেখেছিলেন, ‘নরেন শিক্ষে দেবে, যখন দূরে বাহিরে হাঁক দেবে।’ শিকাগো ধর্মমহাসভায় সেই ‘হাঁক’ ধ্বনিত হতে তখনও আরও ছ’বছর দেরি ছিল। ১৬ দিনে মোট চারটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন স্বামীজি। আমেরিকা জয়ের সেই ইতিহাসকে ফের প্রাণবন্ত করার জন্য প্রয়াসী হয়েছে মনমোহন সিংহের নেতৃত্বাধীন সার্ধশতবর্ষ কমিটি এবং কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রক। তারই জেরে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের চলতি সফরে তিনটি মাইলফলক তৈরি হতে চলেছে।
এই সেই আর্ট অফ প্যালেস।
এক, সেই বক্তৃতাকক্ষে বসানো হবে বিবেকানন্দের স্মৃতিফলক। দুই, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্বোধন করা হবে বিবেকানন্দ চেয়ার। দু’বছরের মেয়াদে যে আসনটি এর পর থেকে অলঙ্কৃত করবেন এক জন করে ভারতীয় অধ্যাপক। তিন, ‘আর্ট ইনস্টিটিউট অফ শিকাগো’য় রবীন্দ্রনাথের আঁকা চিত্রপ্রদর্শনীর উদ্বোধন। শিকাগো ধর্মমহাসভার ‘আর্ট অফ প্যালেস’ ভবনই কিন্তু এখন নাম বদলে হয়েছে ‘আর্ট ইনস্টিটিউট অফ শিকাগো’। গোটা প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করার জন্য গত দু’বছর নিরলস প্রয়াস করেছেন কেন্দ্রীয় সংস্কৃতিসচিব জহর সরকার। তাঁর কথায়, “বিষয়টি অভিনব এই কারণে যে, মার্কিন নাগরিক ব্যতিরেকে কারও স্মৃতিসৌধ অথবা ফলক নেই শিকাগোয়। এই প্রথম বিবেকানন্দ স্মৃতিফলক বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে দেশের সরকার।”
শিকাগো বিমানবন্দরের বাইরে পা রেখেই টের পাওয়া যাচ্ছে শীতের প্রকোপ। তাপাঙ্ক শূন্যের থেকে তিন দাগ নীচে। সেপ্টেম্বরে এতটা না হলেও তাপমাত্রা থাকে শূন্যের কাছাকাছি। অথচ জাহাজে চড়ে কলম্বো-পিনাং-সিঙ্গাপুর-হংকং-জাপান-ভ্যাঙ্কুভার-কানাডা হয়ে অবশেষে শিকাগো পৌঁছেছিলেন যে রমতা যোগী, তাঁর সঙ্গে না ছিল উপযুক্ত শীতবস্ত্র, পাথেয়ও তখন শেষের মুখে। ‘শেষ মুহূর্তে বিনা প্রস্তুতিতে’ই চলে এসেছিলেন। খেতড়ির রাজা তাঁকে একখানি রেশমের বস্ত্র উপহার দিয়েছিলেন। সেটিই সঙ্গে ছিল। আমেরিকায় সেপ্টেম্বরের শীত সম্পর্কে কোনও ধারণাই তখন ছিল না বিবেকানন্দের। নিজেই লিখেছিলেন, ‘‘টাকা আমার কাছে অতি স্বল্পই ছিল--- আর ধর্মমহাসভা বসার আগেই সব খরচ হয়ে গেল। এদিকে শীত আসছে। আমার শুধু গ্রীষ্মোপযোগী পাতলা বস্ত্রখানি ছিল। এক দিন আমার হাত হিমে আড়ষ্ট হয়ে গেল। এই ঘোরতর শীতপ্রধান দেশে আমি যে কী করব ভেবে পেলাম না....।”
ধর্মমহাসভায় বিবেকানন্দ আদৌ বলার সুযোগ পাবেন কি না, সেটাও ছিল মস্ত প্রশ্ন। আয়োজকরা জানিয়েছিলেন, কোনও স্বীকৃত সংগঠনের প্রমাণপত্র ছাড়া কাউকে ‘ডেলিগেট’ হিসেবে গণ্য করা হবে না। ইতিমধ্যে বিবেকানন্দের সঙ্গে যোগাযোগ হয় হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন হেনরি রাইট-এর। রাইট শুধু তাঁকে হার্ভার্ডে আমন্ত্রণই জানালেন না, নিজে চিঠি লিখলেন ধর্মমহাসভার আয়োজকদের। লিখে দিলেন, “আমাদের সমস্ত অধ্যাপককে একত্র করলে যা হবে, এই ব্যক্তির জ্ঞানের পরিধি তার চেয়েও বেশি।” বিবেকানন্দ সম্পর্কে রাইট বলতেন, “আলো ছড়ানোর জন্য সূর্যের যেমন কোনও অনুমতিপত্র লাগে না, আপনারও তাই।”
শিক্ষার যে সব ক্ষেত্রে বিবেকানন্দের বিশেষ উৎসাহ ছিল, তার বিশিষ্ট অধ্যাপকদের জন্য এখন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বিবেকানন্দ চেয়ারের’ জন্য এককালীন ১৫ লক্ষ ডলার দিচ্ছে ভারত। সেই অধ্যাপকের দায়িত্ব থাকবে বিবেকানন্দের পরম্পরাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে বছরে এক বার বক্তৃতা করা। শিকাগোয় অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাস এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে এই বক্তৃতার আয়োজন করা হবে। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “আমার চলতি সফরের লক্ষ্যই হল বিবেকানন্দের ‘শিক্ষে’কে পরবর্তী প্রজন্মের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।” ভারতীয় সময় মধ্যরাত থেকে শুরু হবে অনুষ্ঠান। এই সফরে একাধিক মার্কিন ফরচুন ৫০০ সংস্থার সঙ্গেও বৈঠক করবেন তিনি। ভারত-মার্কিন কৌশলগত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একটি উজ্জ্বল সেতু হিসাবেই বিবেকানন্দকে গণ্য করছেন দু’দেশের শীর্ষ কূটনৈতিক কর্তারা।
আমেরিকা আসার আগে কাশী ছাড়ার সময় স্বামীজি বলেছিলেন, ‘‘আবার যখন এখানে ফিরব, তখন আমি সমাজের উপর একটা বোমার মতো ফেটে পড়ব..।’’ সন্ন্যাসী সত্যদ্রষ্টা। সেই শক্তিধর মানব-বিস্ফোরণের আঁচ ১১৯ বছর পরেও এই শীতার্ত শিকাগোকে উষ্ণ করে রেখেছে!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.