একেবারে হাতের কাছে বাংলাদেশ। দেখাও যায় ও দেশের গ্রাম। সুদৃশ্য রাস্তা। সীমান্ত বাণিজ্যের বহরও খুব কম নয়। অথচ চ্যাংরাবান্ধার সার্বিক উন্নয়ন আজও কেন অধরা সেই প্রশ্নেই কিছুটা উদ্বিগ্ন ব্যাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা। যেমন ফুলকাডাবরির অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক হারাধন সরকারের কথা ধরা যাক। তিনি জানাচ্ছেন, একসময়ে রেল যোগাযোগ ছিল। দীরে ধীরে তা বন্ধ হয়ে চ্যাংরাবান্ধা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। সেই সুবাদে নানা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানও চ্যাংরাবান্ধা থেকে ব্যবসায় গুটিয়ে নিল। হারাধনবাবু বললেন, “রেল যোগাযোগ বন্ধ হতেই ক্রমশ সীমান্ত বাণিজ্যের হাত ধরে এলাকার মানুষের শক্তপোক্ত অর্থনৈতিক ভিত গড়ার স্বপ্নও নষ্ট হলে গেল।” ব্যবসায়ীদের অনেকেরই ধারনা, ট্যাংরাবান্ধায় এখনও হতে পারে আন্তর্জাতিক মানের বাণিজ্যকেন্দ্র। গড়া যেতে পারে পর্যটনকেন্দ্র। কিন্তু কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ ব্লকের চ্যাংরাবান্ধা ২০১২ সালেও কিছুটা যেন কষ্টেসৃষ্টে বাঁচছে। ১৯৬৮ সালের আগেও চ্যাংরাবান্ধা থেকে পার্বতীপুর হয়ে মাত্র আট ঘন্টায় শিয়ালদহে পৌছে যেত ট্রেন। দিনরাত পাট, তামাক সীমান্ত পারাপার করত। কর্মচঞ্চল সীমান্তের ওই জনপদ তখন গ্রাম নয়। দুই বঙ্গে ‘বাণিজ্য বন্দর’ নামে খ্যাত ছিল। যে জিরো পয়েন্ট ঘিরে ঐতিহ্য ফিরে পাওয়ার আকুতি সেখানে নেই বিশ্রামাগার, পানীয় জল ও শৌচাগারের ব্যবস্থা। অথচ প্রতিদিন দুই দেশের কয়েকশো মানুষ পাসপোর্ট নিয়ে ওই পথে যাতায়াত করছেন। শুধু তো মানুষ নয়। ভারত ও ভুটানের কয়লা, পাথর, পেঁয়াজ, ফল, প্লাইউডের মতো রকমারি পণ্য বাংলাদেশে রফতানি হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে আসছে তুলো, ইট, সিন্থেটিক সামগ্রী, ফলের রস ইত্যাদি। চ্যাংরাবান্ধা এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক মূলচাঁদ মুর্চা বলেন, “জিরো পয়েন্ট এলাকায় উত্তর ২৪ পরগনার পেট্রাপোলের মতো আন্তর্জাতিক মানের বাণিজ্য পরিকাঠামো গড়ে উঠলে চ্যাংরাবান্ধা হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে। বিস্তীর্ণ এলাকার ছবি পাল্টে যাবে।” প্রশাসনিক সূত্রের খবর, ওয়াঘা সীমান্তের আদলে চ্যাংরাবান্ধায় ফটক তৈরি হবে। মেখলিগঞ্জ ব্লক প্রশাসন এ জন্য খরচ করবে আট লক্ষ টাকা। শুনুন পণ্য বোঝাই ট্রাক নিয়ে রাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা দিল্লির অনুজ পটেল, হরিয়ানার বিক্রম সিংহ এবং ভুটানের ফুন্টশলিংয়ের রাকেশ শর্মার মতো ট্রাক চালকদের খেদ। তাঁরা জানান, চ্যাংরাবান্ধায় পৌছনোর পরে উদ্বেগ বেড়ে যায়। সন্ধ্যার আগে সীমান্ত পার হতে না-পারলে মুশকিল। কারণ এখানে অন্ধকার রাস্তা এবং চারদিক খোলা টার্মিনাসে গাড়ি রাখার মধ্যে কোনও তফাৎ নেই। রোদ-বৃষ্টির ঝক্কি তো আছেই। রাতে পণ্য সামগ্রীও চুরির হয়। চালকদের সঙ্গে একমত চ্যাংরাবান্ধা ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সম্পাদক তপন দাম। তিনি বলেন, “টার্মিনাসকে ঢেলে সাজানোর দাবি নিয়ে আমরা ফের জেলা প্রশাসনের কাছে যাব।” মেখলিগঞ্জের বিধায়ক তথা প্রাক্তন খাদ্য সরবরাহ মন্ত্রী পরেশ অধিকারী ইতিমধ্যে এলাকার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার দাবি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হয়েছেন। তিনি বলেন, “চ্যাংরাবান্ধা দুষ্কৃতীদের মুক্তাঞ্চলে পরিনত হয়েছে। ঘটনার কথা বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছি।” কী বলছেন পুলিশ ও সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর কর্তারা? সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর চ্যারাবান্ধা ক্যাম্পের কমাণ্ডার বীরপাল সিংহ বলেন, “সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। স্থানীয় দুষ্কৃতীদের মদত থাকায় বহিরাগতদের ঠেকানোর ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে।” জেলা পুলিশ সুপার প্রণব দাস বলেন, “দুষ্কৃতীদের হামলার বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি। সীমান্ত রক্ষী বাহিনী সহ বিভিন্ন এজেন্সির সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” চ্যাংরাবান্ধা ল্যাণ্ড পোর্ট ডেভলপমেন্ট কমিটির সভাপতি সুনির্মল গুহ বলেন, “চ্যাংরাবান্ধায় থানা তৈরির দাবি জানানো হয়েছে।” বিডিও সপ্তর্ষি নাগ মনে করেন নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত জরুরি প্রস্তাব। জেলা পুলিশ কর্তারাও দাবির যৌক্তিকতা স্বীকার করেছেন। জেলা পুলিশ সুপার বলেন, “বাসিন্দার দাবির কথা কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।” নিরাপত্তা নিয়ে কোনও অভিযোগ তাঁর কাছে পৌঁছায়নি বলে দাবি করেছেন কোচবিহার জেলা পরিষদের সভাধিপতি দিলীপ বিশ্বাস। তাঁর বক্তব্য, “আড়াই কোটি টাকা খরচ করে টার্মিনাস তৈরি করা হয়েছে। চারদিকে প্রাচীর হবে। সেখানে আলোর সমস্যা থাকার কথা নয়। নিরাপত্তার খামতি নিয়ে কেউ জানায়নি।” জেলাশাসক মোহন গাঁধী দাবি করেন, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক প্রতিনিধি চ্যাংরাবান্ধা ঘুরে কিছু প্রকল্পের কথা বলেন। জেলাশাসক বলেন, “দেখা যাক কী হয়।” |