আত্মঘাতীরা কৃষক কি না, এই তরজায় আটকে বাস্তব পরিস্থিতি থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাখছেন সব রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব। আর তাই আত্মহত্যার পরিস্থিতি থেকে মুক্তির উপায় মিলছে না। এই কথা বলছেন অর্থনীতির শিক্ষক ও কৃষি বিজ্ঞানীদেরই একাংশ।
কী সেই বাস্তব পরিস্থিতি? অর্থনীতির শিক্ষক এবং কৃষি বিজ্ঞানীরা বলছেন, “পশ্চিমবঙ্গে কৃষকদের কাছে এক লপ্তে বড় জমি নেই। পরিবার যত ভাঙছে, ব্যক্তিগত জমির পরিমাণ তত কমে যাচ্ছে। অন্য দিকে, চাষের খরচ বাড়ছে। তুলনামূলক ভাবে বাড়েনি ফসলের দাম। তাই কৃষি আর লাভজনক নেই।”
তাঁদের বিশ্লেষণ, “উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে নানা ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছেন কৃষকেরা। বাজার থেকে ঋণ নিচ্ছেন। কিন্তু লাভ না হওয়ায় বছর বছর আরও বেশি করে ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছেন তাঁরা।” তাঁদের আশঙ্কা, পরিস্থিতির মোকাবিলায় এখনই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা না নেওয়া হলে ভবিষ্যতে আরও বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। সমস্যার মূলে না গিয়ে রাজনৈতিক নেতা ও মন্ত্রীদের এখন তরজার বিষয়, আত্মঘাতী ব্যক্তিরা কৃষক না কৃষক নন! সরকারের তরফে বারবারই বলা হচ্ছে, ওঁরা কৃষক নন। সরকারের শরিক ও বিরোধীরা প্রায় একযোগে উল্টো দাবি করছেন। তাঁদের আরও দাবি, আত্মঘাতীরা কৃষক না কৃষক নন, তা খুঁজে দেখতে একটি সর্বদলীয় কমিটি গড়া হোক। এই তরজায় এবং দাবি-পাল্টা দাবির গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাচ্ছে মূল বিষয়টি। তার সমাধান কী ভাবে সম্ভব, চাপা পড়ে গিয়েছে সেই ব্যাপারটিও।
এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চাষের জমিকে অন্য ভাবে ব্যবহার করার পাশাপাশি চাষের পদ্ধতি বদলের পরামর্শ দিচ্ছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য কৃষিবিজ্ঞানী রথীন্দ্রনারায়ণ বসু। তিনি বলেন, “চাষের বিভিন্ন সামগ্রীর (সার, কীটনাশক ইত্যাদি) দাম আরও বাড়বে। এই অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে চাষের পদ্ধতিটাকেই আমূল বদলে ফেলতে হবে। কৃষির উপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা কমাতে হবে বলেও তাঁর নিদান।
চাষের জমিকে অন্য ভাবে ব্যবহার করার পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদদের একাংশও। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “কৃষি থেকে শিল্পে উত্তরণ ঘটাতে হবে। উন্নয়নের এই প্রক্রিয়া প্রাথমিক ভাবে নানা সমস্যার জন্ম দেবে। তবে সবাই মিলে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।” সিঙ্গুরে টাটাদের কারখানা গড়ার ক্ষেত্রে এমন সমস্যাই হয়েছিল বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদদের একাংশ। তাঁরা মনে করছেন, এ ব্যাপারে চাষিদের বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছিল তৎকালীন শাসক দলও। আর তৎকালীন বিরোধীরা বিষয়টির গভীরে না গিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ দেখেছেন।
রাজনৈতিক দলগুলি এই সিঙ্গুর-উত্তর পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। এখনও তাঁরা নিজেদের মতো করেই কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়ে চাপানউতোরে জড়িয়ে পড়ছে। অর্থনীতির এক শিক্ষকের ব্যাখ্যা, “এ যেন প্রাক-গ্যালিলিও যুগের পৃথিবী সম্পর্কে মানুষের ভাবনার মতো। সেই সময়ে এক শ্রেণির মানুষ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন যে, পৃথিবীটা গোল নয়। পৃথিবীটা একটা সমতলের মতো। তার দুই দিকে খাদ। শেষ প্রান্তে গেলেই বুঝি পড়ে যেতে হবে। গ্যালিলিও প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের পরেও ওই মানুষরা বাস্তব অবস্থাটা মানতে চান না কিছুতেই। কৃষি নিয়ে এ রাজ্যে এখন যেন সেই অবস্থাটাই চলছে।”
ওই অর্থনীতির শিক্ষকের মন্তব্য, “কোনও রাজনৈতিক দলের নেতাই আসল সমস্যাটা বুঝতে চাইছেন না। অনেকে বুঝলেও তা প্রকাশ্যে জানাতে পারছেন না। তাতে রাজনৈতিক ভাবে তাঁদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।”
কী ভাবে? ওই অর্থনীতির শিক্ষক বলেন, “পূর্বতন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বাস্তব পরিস্থিতিটা বুঝে সিঙ্গুরের তিন ফসলি জমিতে শিল্প গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। কিন্তু মানুষ তাঁকে সেই জন্য প্রত্যাখ্যান করেছে। আর সিপিএম-ও রাজনৈতিক স্বার্থে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সেই পথ থেকে সরে এসেছে।” পরিবেশ বিজ্ঞানীদের একাংশ বলছেন, তিন ফসলি চাষের জমিতে বারবার চাষের ফলে যে পরিমাণ জল লাগে, তাতে ওই জমির জলস্তর নেমে যায়। ফলে ভবিষ্যতে আর্সেনিক বা ফ্লোরাইড দূষণের সমস্যা বড় আকার নিতে পারে।
মঙ্গলবারও সারাদিন রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক নেতারা একই ভাবে জড়িয়ে রইলেন আত্মঘাতীদের কৃষক পরিচয় নিরূপণ নিয়ে তরজায়। হাওড়ার শ্যামপুরে বালিকুড়িয়া গ্রামে আত্মঘাতী শেখ মোস্তাফার স্ত্রী রামিশার সঙ্গে দেখা করেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। পরে তিনি বলেন, “কে কী বলছেন জানি না। ঋণের দায়ে আত্মঘাতী হচ্ছেন প্রকৃত চাষিরাই।” প্রদীপবাবুর এই বক্তব্যের পরেই রাজ্যের কৃষিবিপণনমন্ত্রী অরূপ রায় বলেন, “মোস্তাফা চাষি ছিলেন না। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে চাষের সম্পর্ক নেই। কংগ্রেস ও সিপিএম এই ঘটনা নিয়ে নিম্নমানের রাজনীতি করছে।”
এর মধ্যেই বিভিন্ন জেলায় কৃষকদের মৃত্যুর অভিযোগ খতিয়ে দেখতে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বিধানসভার সর্বদলীয় প্রতিনিধিদল পাঠানোর আর্জি জানায় সিপিআইয়ের কৃষক সংগঠন পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কৃষক সভা। কিন্তু সেই দাবি খারিজ করে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর প্রতিবাদে ১ ফেব্রুয়ারি রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় আন্দোলনে নামছে সংগঠনটি। একই দাবিতে এ দিন এসইউসি-র কৃষক সংগঠনের প্রতিনিধিরা খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের সঙ্গে দেখা করেন। পরে তাঁরা জানান, ২ ফেব্রুয়ারি সব জেলায় জেলাশাসকের দফতরের সামনে তাঁদের সংগঠন অবরোধ কর্মসূচি নিয়েছে। পরে খাদ্যমন্ত্রী জানান, ধান-চাল সংগ্রহের অবস্থা খতিয়ে দেখতে শনিবার মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে মহাকরণে জরুরি বৈঠক বসছে।
মূল সমস্যায় না গিয়ে কৃষিমন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যও বিরোধীদের অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে বলেছেন, “কৃষিপ্রধান এই রাজ্যে প্রতি বছর গড়ে কৃষক পরিবারের ১২০০ থেকে ১৫০০ জন আত্মহত্যা করেন। তা হলে কি বলতে হবে এঁরা সকলেই অভাবি বিক্রির কারণে আত্মহত্যা করেছেন?”
কিন্তু রাজ্যে বর্তমানে এই সমস্যার সমাধান কী ভাবে সম্ভব, তা নিয়ে কৃষিমন্ত্রী নীরবই ছিলেন। |