নদিয়ার মাজদিয়ার সুধীরঞ্জন লাহিড়ি কলেজে অধ্যক্ষ-নিগ্রহে অভিযুক্ত এসএফআই-সমর্থক তিন ছাত্রের জামিনের আবেদন ফের নাকচ করল আদালত। কৃষ্ণনগরে জেলা বিচারকের এজলাসে মঙ্গলবার তাঁদের আবেদন নিয়ে শুনানি ছিল। তিন ছাত্রের আইনজীবী, চাপড়ার প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক সামসুল ইসলাম মোল্লা জামিনের আর্জি পেশ করেন। সরকারি কোঁসুলি কিশোর মুখোপাধ্যায় আবেদনের বিরোধিতা করেন। জেলা বিচারক আশা আরোরা অবশ্য সেই আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। পরে সামসুল বলেন, “এই নির্দেশ সঠিক বলে আমরা মনে করি না। আমরা হাইকোর্টে আবেদন করব।”
রায়গঞ্জে কলেজের অধ্যক্ষ-নিগ্রহের ঘটনায় অভিযুক্ত তৃণমূলের নেতা এবং ছাত্র সংগঠনের সমর্থকদের বিরুদ্ধে ‘জামিনযোগ্য’ ধারায় মামলা হয়েছিল। পক্ষান্তরে, মাজদিয়ার ঘটনায় অভিযুক্ত এসএফআই সমর্থকদের বিরুদ্ধে ‘জামিন-অযোগ্য’ ধারা প্রয়োগ করা হয়েছিল। তখনই শাসক ও বিরোধীদের ক্ষেত্রে প্রশাসনের ‘দ্বিমুখী’ আচরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। রায়গঞ্জের অভিযুক্তেরা অনেক আগেই জামিন পেয়ে গিয়েছেন। মাজদিয়ার ছাত্রদের এ দিনও জামিন না-হওয়ায় স্বভাবতই রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে ‘দ্বিচারিতা’র অভিযোগে ফের সরব হয়েছে বিরোধী সিপিএম। তবে একই সঙ্গে তাদের নজর রাখতে হচ্ছে, আদালত যেন কোনও ভাবেই সমালোচনার অভিমুখ হয়ে না-ওঠে। প্রধান বিরোধী দল আক্রমণ শানাচ্ছে রাজ্য প্রশাসন এবং প্রধান শাসক দলের বিরুদ্ধেই।
বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র যেমন এ দিন বলেছেন, “রাজ্য জুড়ে স্লোগান উঠেছে, রায়গঞ্জে ‘বেল’ (জামিন) আর মাজদিয়ায় জেল! এই দ্বিচারিতার আমরা প্রতিবাদ করছি। রায়গঞ্জ এবং মাজদিয়ার ঘটনায় সরকারের দু’রকম আচরণ নিয়ে আমরা রাজ্যপালকে অবহিত করেছিলাম। তার অব্যবহিত পরেই রাজ্যপাল প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। সংবাদমাধ্যমে গোটা ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে, বিশিষ্ট জনেরা প্রতিবাদ করেছেন। তার পরেও দেখা যাচ্ছে, সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং প্রতিহিংসামূলক মনোভাব নিয়ে চলছে। দলতান্ত্রিক মনোভাবই দেখা যাচ্ছে।” রায়গঞ্জ-কাণ্ডের নিন্দা করেও তাকে ‘ছোট্ট ঘটনা’ বলে অভিহিত করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সূত্র ধরেই বিরোধী দলনেতার মন্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ছোট্ট ঘটনা! ছোট্ট ছেলেরা করেছে! মাজদিয়ার ছেলেরা তো আরও ছোট্ট! তাদের সঙ্গে এই আচরণ কেন?” সূর্যবাবুর মতে, শিক্ষার আঙিনায় শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে প্রশাসন ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ হলে চলবে না।
তিন ছাত্রের জামিনের আবেদন নাকচ হওয়ায় ‘ক্ষুব্ধ’ এসএফআই নেতৃত্বও। সংগঠনের নদিয়া জেলা সম্পাদক কৌশিক দত্ত বলেন, “রায়গঞ্জ কলেজে বহিরাগতেরা ঢুকে অধ্যক্ষকে মারধর করল। তার ভিডিও ফুটেজও রয়েছে। তারা জামিন পেয়ে গেল। আর মাজদিয়া কলেজে শুধুমাত্র অধ্যক্ষের অভিযোগের ভিত্তিতে তিন ছাত্রের বিরুদ্ধে পুলিশ জামিন অযোগ্য ধারা দিল। ছাত্র আন্দোলনের মেরুদণ্ড ভেঙে দিতেই এমন করা হচ্ছে!” রায়গঞ্জে ভিডিও ফুটেজে স্পষ্টই দেখা গিয়েছিল অধ্যক্ষ নিগ্রহের ঘটনা। সেখানে জড়িত ছিল শাসক তৃণমূলের স্থানীয় কয়েক জন নেতা এবং তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) সমর্থকেরা। কৌশিকের অভিযোগের তির শাসক-শিবিরের সেই নেতা-সমথর্কদের দিকেই। মাজদিয়ার এসএফআই সমর্থকদের জামিন নাকচ হওয়া প্রসঙ্গে টিএমসিপি-র নদিয়া জেলা সভাপতি জয়ন্ত পালের সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, “বিচার ব্যবস্থায় আস্থা আছে। আইন আইনের পথেই চলছে।” আর সুধীরঞ্জন কলেজের অধ্যক্ষ সরোজেন্দ্রনাথ করের মন্তব্য, “বিষয়টি বিচারাধীন। এই মুহূর্তে ধৃত ছাত্রদের জামিন না-পাওয়া নিয়ে কিছু বলা ঠিক হবে না।” প্রসঙ্গত, বিধানসভার স্পিকার, আইনজীবী বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় এর আগে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, কোথায় জামিনযোগ্য এবং কোথায় জামিন-অযোগ্য ধারা প্রয়োগ হবে, তা অভিযোগের ধরনের উপরেই নির্ভর করে।
গত ৭ জানুয়ারি সরোজেন্দ্রনাথবাবুর উপরে জনাকয়েক এসএফআই-সমর্থক ছাত্র চড়াও হয়েছিলেন বলে অভিযোগ। ওই দিনই তিনি কৃষ্ণগঞ্জ থানায় কলেজের ৫ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। সে রাতেই পুষ্পেন সরকার, প্রণব ঘোষ ও অভিজিৎ হালদারকে গ্রেফতার করে পুলিশ। অন্য দুই অভিযুক্ত ছাত্র অবশ্য এখনও ফেরার। ধৃতদের ৮ জানুয়ারি সিজেএম আদালতে হাজির করানো হলে বিচারক তাঁদের ১৪ দিন জেল-হাজতের নির্দেশ দেন। গত ১৩ ও ২১ জানুয়ারি ফের জামিনের আবেদন না-মঞ্জুর করেন সিজেএম। তিনি ওই ছাত্রদের ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জেল হাজতের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে জেলা বিচারকের এজলাসে ফের জামিনের আবেদন করেন জেলবন্দি তিন ছাত্রের আইনজীবী। সেই আবেদনেরই শুনানি ছিল মঙ্গলবার। |