পাকিস্তান আবার সন্ধিক্ষণে। এক দিকে সেনাবাহিনী ও বিচারবিভাগ, অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির সরকার। প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত ও পাক সেনাবাহিনীকে সামরিক অভ্যুত্থান হইতে নিরস্ত করিতে মার্কিন সেনাপ্রধানের কাছে আর্জি জানাইবার অভিযোগের তদন্তকে কেন্দ্র করিয়া প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচিত সরকারের উপর চাপ বাড়ানো হইতেছে। এই কাজে সেনাবাহিনীর সহিত একই পক্ষে দাঁড়াইয়া গিয়াছেন পাক সুপ্রিম কোর্ট। পাকিস্তানের ৬৪ বছরের ইতিহাসে সেনাবাহিনী কখনওই কোনও নির্বাচিত সরকারকে তাহার পুরা মেয়াদ শাসন করিতে দেয় নাই। গিলানি সরকারের চার বছর যাইতে-না-যাইতে তাহারও বিদায়ঘণ্টা সেনাছাউনি ও আদালত চত্বরে বাজিয়া উঠিতেছে কি না, প্রশ্ন সেটাই।
সত্য, গিলানি সরকার দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করিয়াছে, এমন দাবি করা যাইবে না। সত্য, প্রেসিডেন্ট জারদারি কোনও জনপ্রিয় রাজনীতিক নহেন, নিহত বেনজির ভুট্টোর প্রতি গণ-সহানুভূতির হাওয়া পালে লাগাইয়াই তিনি দলপতি এবং প্রেসিডেন্ট পদ হাসিল করিয়াছেন। কিন্তু তাঁহার বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগগুলি পুরানো। এই ধরনের অভিযোগ বিরোধী নেতা নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধেও আছে, আছে আরও বহু রাজনীতিকের বিরুদ্ধে। সুপ্রিম কোর্ট কিন্তু তাঁহাদের লইয়া পড়ে নাই। সবচেয়ে বড় কথা, সেনাবাহিনী ও সামরিক গোয়েন্দা চক্র আইএসআইয়ের বিভিন্ন সন্ত্রাস-সমর্থক ক্রিয়াকলাপ এবং সে জন্য তহবিল সংগ্রহে রকমারি আর্থিক অনিয়মের তদন্তের কথাও শীর্ষ আদালতকে কখনও বলিতে শোনা যায় নাই। পাক সেনাধ্যক্ষ জেনারেল কিয়ানি যে মাঝেমধ্যেই নির্বাচিত সরকারকে হুমকি দিতেছেন, তাহার অসাংবিধানিকতা লইয়াও সুপ্রিম কোর্টকে বিচলিত হইতে দেখা যাইতেছে না। বিশ্বের কুখ্যাততম সন্ত্রাসবাদী ওসামা বিন লাদেন কেমন করিয়া সেনা বা আইএসআই প্রশ্রয়ে অ্যাবটাবাদের ফৌজি শহরে ছয় বছর ধরিয়া বহাল তবিয়তে থাকিয়া গেলেন, বিচারপতিরা তাহার তদন্তেও আগ্রহী নহেন। ইহার কোনওটিই বিচারবিভাগীয় নিরপেক্ষতার পরিচায়ক নয়। গণতন্ত্রকে কোনও দেশের মাটিতে শিকড় প্রোথিত করিতে হইলে প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনপ্রণালী চর্চার যথার্থ এবং নিয়মিত সুযোগ পাইতে হয়। অনির্বাচিত জেনারেল বা বিচারপতিরা নহেন, জন-নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই তাঁহাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হইবেন, এই বন্দোবস্ত শিরোধার্য করিয়া লইতে হয়। পাকিস্তানের দুর্ভাগ্য, শুরু হইতেই দেশের মানুষ গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতায় সেনাবাহিনীর উচ্চাকাঙ্ক্ষী জেনারেলদের অন্তর্ঘাতের শিকার হইয়াছেন। অন্য যে-কোনও দেশ হইলে যেখানে আয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, জিয়া-উল-হক, পারভেজ মুশারফ বা পারভেজ কায়ানিদের অসামরিক সরকার বরখাস্ত করিয়া দিত, পাকিস্তানে সেখানে এই জেনারেলরাই নির্বাচিত সরকারকে বরখাস্ত করিয়া নিজেদের অবৈধ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিতে উদ্যত হইয়াছেন। সেই অপকর্মে বরাবরই অবশ্য কিছু অসামরিক রাজনীতিক ও আমলা সহায়তা করিয়াছেন। জেনারেল কিয়ানি ও শুজা পাশাদেরও সাহায্য করিতে যেমন এখন আগাইয়া আসিয়াছেন ইমরান খানের মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজনীতিক ও দেশের শীর্ষ ন্যায়ালয়ের কিছু বিচারপতি। পার্লামেন্টে আস্থাভোট লইয়া গিলানি তাঁহার সরকারের গরিষ্ঠতার প্রমাণ দিয়াছেন বটে। কিন্তু যাহারা জনপ্রতিনিধিত্বের বৈধতা স্বীকার করে না, তাহারা পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বের তত্ত্বে আস্থা রাখিবে কেন? পাকিস্তানে গণতন্ত্র অতএব ঘোর দুঃসময়ে পতিত। |