‘সমাপ্তি’ গল্পে নায়কের নাম ছিল অপূর্ব। কিন্তু অপূর্বের ভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বললে অপু ছাড়া আর কিচ্ছুটি মনে হওয়া সম্ভব কি? ‘সমাপ্তি’ করতে গিয়ে সত্যজিৎ তাই সৌমিত্রর নাম বদলে দিলেন। মৃন্ময়ীর নায়কের নাম হল অমূল্য।
সেই অপুর সঙ্গেই আবার দেখা হতে চলেছে সৌমিত্রর। একটি নতুন ছবিতে, যার নাম ‘অপু এবং অপু’।
১৯৬৬ সালে উত্তমকুমারকে ভেবে সত্যজিৎ রায় বানিয়েছিলেন নায়ক। সেই ছবিকে সামনে রেখে ২০১০ সালে প্রসেনজিৎকে নিয়ে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘অটোগ্রাফ’ বক্স অফিসে তুফান তুলল। এ বার অপু-সৌমিত্র সংলাপ সেই ধারাবাহিকতাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দিতে চলেছে।
কী ভাবে?
‘অপুর সংসার’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৯-এ। তার ৫০ বছর পরে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একটা গল্প বলেছিলেন এক অনুজ স্নেহভাজনকে। বলেছিলেন, তখন উনি লন্ডনে। চিকিৎসা চলছে। ‘অপুর সংসারে’র ৫০ বছরে বন্ধুদের সঙ্গে বসে ছবিটা দেখা হল। তার পর একটা সময় উনি একা বাড়িতে। হঠাৎ ওঁর মনে হল, কোনটা বেশি সত্যি আসলে?
পর্দার ওই অপু? নাকি উনি মানুষটি নিজে?
এই ভাবনাটাকে আকর করেই তৈরি হয়ে উঠল একটা ছবির গল্প। লেখক সেই অনুজ শ্রোতা, শোভন তরফদার। ছবিটা পরিচালনা করবেন তিনিই। ছবিতে সৌমিত্র অভিনয় করবেন সৌমিত্রর ভূমিকাতেই। তাঁর অভিনীত আরও নানা চরিত্রের অনুষঙ্গ ঘুরেফিরে আসবে ছবি জুড়ে। ‘চারুলতা’, ‘অভিযান’, ‘তিন কন্যা’, ‘আকাশকুসুম’, ফেলু সিরিজ... মায় ‘রাজা লিয়ার’ পর্যন্ত। এর আগে সৌমিত্রকে নিয়ে একাধিক তথ্যচিত্র হয়েছে। কিন্তু তাঁকে বিষয় করে কাহিনিচিত্র এই প্রথম। সেদিক থেকে এ ছবিকে বলা যায়, ‘বাই সৌমিত্র, অফ সৌমিত্র, ফর সৌমিত্র’। সৌমিত্রকে নিয়ে, সৌমিত্রকে দিয়ে বানানো সৌমিত্ররই ছবি।
খবরটা শুনে উত্তেজিত সৃজিত বললেন, ‘‘ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো দেখতে যাব! কিছু কিছু ছবি শুধু ছবি হয়ে না থেকে আমাদের জীবনের অংশ হয়ে যায়। ‘নায়ক’ বা ‘অপুর সংসার’ ঠিক তেমনই।” |
বস্তুত সৃজিত-শিবপ্রসাদ-অনিরুদ্ধ-মৈনাকদের ছবির সূত্রে টালিগঞ্জ যে নতুন সাফল্যের মুখ দেখেছে, সেটাই অনেকাংশে ‘অপু এবং অপু’-র মতো ব্যতিক্রমী কাহিনি নিয়ে ছবি তৈরির সাহস জোগাচ্ছে। গত কয়েক বছরে ‘অনুরণন’, ‘অন্তহীন’, ‘শুকনো লঙ্কা’, ‘অটোগ্রাফ’, ‘ইচ্ছে’, ‘বাইশে শ্রাবণ’ ফর্মুলার বাইরে গিয়ে নবীন পরিচালকদের একের পর এক ছবি জনপ্রিয় হয়েছে। এ বছরে ইতিমধ্যেই মুক্তি পেয়েছে ‘বেডরুম’। দর্শকের আনুকূল্যও পেয়েছে। আগামী শুক্রবার আসছে ‘অপরাজিতা তুমি’। এই আবহে ‘অপু এবং অপু’-র প্রযোজক পি পি তিওয়ারি পরিষ্কার বলছেন, “বাংলা ছবি এখন দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। শিক্ষিত ও অভিজাত রুচির দর্শক আবার হলে আসছেন। ‘অপু এবং অপু’-র মতো ছবি তাঁদের মন টানবে বলে আমাদের বিশ্বাস।”
এটা কি ‘অপুর সংসারে’র রিমেক? শোভনের উত্তর, ‘‘আমি রিমেকে বিশ্বাসী নই। সেই স্পর্ধাও নেই। আমি শুধু আমার সময়ে দাঁড়িয়ে ছবিটার সঙ্গে কথা বলছি মাত্র।” সেখানে অপু আর অপর্ণা রিয়ালিটি শো-এর চরিত্র হয়ে সৌমিত্রের দুঃস্বপ্নে হানা দেয়। সেই দ্বিতীয় অপুর ভূমিকায় থাকছেন ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত। ‘নায়ক’-অনুপ্রাণিত ‘অটোগ্রাফ’-এর পর ‘অপুর সংসার’-অনুপ্রাণিত ‘অপু এবং অপু’ দুটি ছবিতেই তিনি। এ-ও এক ধারাবাহিকতা বটে। শুধু তা-ই বা কেন? অতনু ঘোষের ‘অংশুমানের ছবি’তেও দেখা গিয়েছে, প্রবীণ অভিনেতার ভূমিকায় সৌমিত্র আর নবীন পরিচালকের ভূমিকায় ইন্দ্রনীল। সেখানেও সৌমিত্রের চরিত্রে আত্মজৈবনিকতার হাল্কা ছোঁয়া, ‘ঝিন্দের বন্দি’-র উল্লেখ। কেমন লাগছে এই গতিপথের কথা ভেবে? ইন্দ্রনীল বললেন, “এটা কিন্তু একেবারেই কাকতালীয়। অপু নামের একটা চরিত্র করা, তা-ও সৌমিত্রবাবুর সঙ্গে, এটা বিরাট চ্যালেঞ্জ!”
‘অপুর সংসারে’ অপুর উপন্যাসের প্লট শুনে পুলু বলেছিল, “উপন্যাস কোথায়? এ তো আত্মজীবনী!” অপু প্রতিবাদ করেছিল। পরে পাণ্ডুলিপিটা পড়ে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল পুলু। সৌমিত্র নিজে কী ভাবছেন ‘অপু এবং অপু’ নিয়ে? সৌমিত্র বললেন, ‘‘এর মধ্যে বেশ কিছু উপাদান আছে, যা আমার জীবনসত্যের খুব কাছাকাছি। ‘তৃতীয় অঙ্ক অতএব’ নাটকটাতেও নিজের চরিত্রই করি। কিন্তু আত্মজীবনীর উপাদান যতই থাকুক না কেন, অভিনয়ের সময় সেটা চরিত্রই।” আজ বৃহস্পতিবার, সৌমিত্রর জন্মদিন। ৭৭ পূর্ণ হবে। সন্ধেয় নাটক, ‘তৃতীয় অঙ্ক অতএব’। তার আগে বুধবার সন্ধেবেলাতেই সই করেছেন ‘অপু এবং অপু’। আবারও একটি ‘চরিত্র’ হয়ে উঠবেন তিনি, চরিত্রের নাম যেখানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। |