পরিবার-প্রতিবেশীদের ঘাড়েই দোষ চাপিয়ে দায় এড়াচ্ছে রাজ্য সরকার
উদ্ধার চুরি যাওয়া শিশু, ধৃত দম্পতি
ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে চুরি যাওয়া সদ্যোজাতের হদিস মিলল। পুলিশ জানিয়েছে, রবিবার সন্ধ্যায় বেনিয়াপুকুর থানার পুলিশ ‘গোপন সূত্রে’ খবর পেয়ে ব্রড স্ট্রিটের একটি ফ্ল্যাটে হানা দিয়ে এক দম্পতির কাছ থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করেছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ওই দম্পতিকে। বাচ্চাটির ‘হদিস’ মেলায় স্বাস্থ্যকর্তারা স্বস্তির শ্বাস ফেললেও শিশুচুরির ঘটনাটিকে ঘিরে সরকারি তরফে দায় এড়ানোর প্রবণতাও এ দিন সামনে এসেছে।
এ দিন দুপুরেই সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে স্বাস্থ্যকর্তারা দাবি করেছিলেন, চুরির ঘটনায় শিশুর পরিবার বা প্রতিবেশীদের কারও যোগ রয়েছে। স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরিই বলে দিয়েছিলেন, “চুরি তো করেছে বাড়ির লোক! হাসপাতাল কী করবে? বাড়ির লোক বলে পরিচয় দিয়ে যাকে গ্রিন কার্ড ধরিয়ে দিয়েছে, সে-ই বাচ্চাকে নিয়ে গেলে হাসপাতাল আটকাবে কী করে?”
ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে চুরি যাওয়া সেই শিশু।
উদ্ধারের পর বেনিয়াপুকুর থানায়। রবিবার। ছবি: সুমন বল্লভ
বাস্তবে, পুলিশি তদন্তের ফলাফল কিন্তু অন্য কথা বলছে। স্বাস্থ্যকর্তাদের দাবি কার্যত নস্যাৎ করে দিয়ে ডিসি (ইএসডি) সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, অভিযুক্তদের সঙ্গে সদ্যোজাত শিশুটির পরিবারের কোনও আত্মীয়তা নেই।” ডিসি বলেন, “ধৃতেরা হল নিলোফার রহমান (২৩) ও তাঁর স্বামী শেখ রাজু (২৭)। তাঁরা বারুইপুরের বাসিন্দা। দীর্ঘ দিন বিয়ে হলেও ওই দম্পতির সন্তান ছিল না। সেই কারণেই তাঁরা এই কাজ করেছেন কি না, তা যাচাই করে দেখা হচ্ছে।” ব্রড স্ট্রিটে নিলোফারের মা রেহানা বেগমের বাড়ি থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করা হয় বলে পুলিশ জানিয়েছে। ওই মহিলাকেও পুলিশ আটক করেছে। ওই এলাকার বাসিন্দাদের মাধ্যমেই পুলিশ শিশুটির খবর পায়।
স্বাস্থ্য দফতরের শীর্ষ কর্তারা কিন্তু এর পরেও নিজেদের ‘অবস্থান’ পাল্টাতে রাজি নন। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তার দাবি, “যা শুনেছি, যাঁদের বাচ্চা চুরি গিয়েছিল, অভিযুক্তরা তাঁদের পরিচিত। এক পাড়ারই লোক।” ‘চুরি’ যাওয়া শিশুটির বাবা শেখ ওয়াসিমের কিন্তু অভিযোগ, “হাসপাতালের লোকেরা আমার স্ত্রীকে (কানিজ বেগম) কাগজে লিখে দিতে বলে যে, আমাদের বাচ্চাটিকে কোনও আত্মীয়ই নিয়ে গিয়েছে। ও রাজি না-হলেও ওরা চাপ দিচ্ছিল।” ন্যাশনালের সুপার পার্থপ্রতিম প্রধান এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
এ দিন দুপুরে হাসপাতালের অধ্যক্ষ ও সুপারকে সঙ্গে নিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন স্বাস্থ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র-সহ স্বাস্থ্যকর্তারা। সেখানেও শিশু চুরির পিছনে বাড়ির লোকের ‘অসতর্কতা’ই দায়ী বলে দাবি করেন স্বাস্থ্যকর্তারা। বাড়ির লোক ‘সতর্ক না-থাকলে’ রোগীর চাপে জেরবার সরকারি হাসপাতালে শিশু চুরি আটকানো যে প্রশাসনের পক্ষে সব সময়ে সম্ভব না-ও হতে পারে, তাঁদের বক্তব্যে পরিষ্কার ছিল সেই ইঙ্গিত। স্বাস্থ্য-সচিবের কথায়, “সরকারি হাসপাতালগুলোয় যে সংখ্যক রোগীকে নিত্য পরিষেবা দেওয়া হয়, তাতে সুপারম্যানের পক্ষেও এটা বলা অসম্ভব যে, এমন ঘটনা কোনও দিনও ঘটবে না।”
কিন্তু দিনেদুপুরে হাসপাতালের মহিলা বিভাগের গেট দিয়ে এক মহিলা কী ভাবে একটি সদ্যোজাতকে কোলে নিয়ে নির্বিবাদে বেরিয়ে গেলেন? নিরাপত্তাকর্মীরা কেউ তাঁর কাছে ডিসচার্জ সার্টিফিকেট বা সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র দেখতে চাইলেন না?
পুলিশি তদন্তে প্রকাশ, অভিযুক্ত মহিলা চাদরের নীচে বাচ্চাটিকে লুকিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যান। তার আগে কানিজ বেগমের সঙ্গে আলাপ করেন তিনি। শিশুটিকে কোলে তুলে আদরও করেন। প্রসবের পরে কানিজ বেগম তখনও ‘আচ্ছন্ন’ অবস্থায়। এক ফাঁকে শিশুটিকে লুকিয়ে ওয়ার্ড থেকে তিনি বেরিয়ে যান।
সরকারি হাসপাতালগুলোয় যে সংখ্যক রোগীকে নিত্য
পরিষেবা দেওয়া হয়, তাতে সুপারম্যানের পক্ষেও বলা
অসম্ভব যে, এমন ঘটনা কোনও দিনও ঘটবে না।
সঞ্জয় মিত্র, স্বাস্থ্যসচিব
হাসপাতালের নিরাপত্তার ‘খামতি’ নিয়ে অভিযোগকে আমল না-দিয়ে স্বাস্থ্যকর্তারা কিন্তু শিশুটির মা এক ‘অপরিচিতা’র কোলে সন্তানকে তুলে দিয়েছিলেন বলেই দাবি করে চলেছেন। সঞ্জয়বাবু বলেন, “কিছু ত্রুটি আছে। তাই নিরাপত্তা আরও বাড়ানো হবে। সিসিটিভি’র সংখ্যাও বাড়বে। কিন্তু ওয়ার্ডে থাকার জন্য রোগীর বাড়ির লোককে যে গ্রিন কার্ড দেওয়া হয়, সেটা তাঁরা অপরিচিতের হাতে তুলে দিলে আমরা কী করতে পারি?”
তা হলে সরকারি হাসপাতালে সদ্যোজাতের কি কোনও নিরাপত্তা থাকবে না? প্রকারান্তরে কি সেটাই বলতে চাইছেন তাঁরা?
উত্তরে ঘুরিয়ে বাড়ির লোকের দিকেই আঙুল তুলেছিলেন স্বাস্থ্যকর্তারা। সচিব বলেছিলেন, “বাড়ির লোকের যতটা দায়িত্ব নেওয়া উচিত ছিল, তা তাঁরা নেননি। ওঁরা যথেষ্ট সতর্ক ছিলেন না। মায়ের চেয়ে বেশি নিরাপত্তা শিশুকে আর কেউ দিতে পারেন না।” স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার যুক্তি, “অনেক রোগিণী বা তাঁদের বাড়ির লোক বোরখা পরেন। সে ক্ষেত্রে নিরাপত্তারক্ষীদের পক্ষেও বোঝা খুব মুশকিল। আর সরকারি হাসপাতালে রোগীর যে চাপ, যা ভিড়, তাতে কেউ যদি চুরি করতে চায়, তা হলে চুরি হবেই।”
শুক্রবার বিকেলে তপসিয়ার বাসিন্দা কানিজ বেগমের দু’দিনের পুত্রসন্তান চুরির তদন্তে নেমে ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশনের (সিসিটিভি) ফুটেজ থেকে পুলিশ কিছু সূত্র পেয়েছিল। তাতে দেখা যায়, শুক্রবার দুপুরে বোরখা পরিহিতা দুই মহিলা ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছে। তাদের এক জনের হাতে ছিল ওয়ার্ডে ঢোকার সবুজ রঙের ছাড়পত্র।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর: নার্সের ঘাটতির দরুণ সব হাসপাতালেই রোগীর দেখভালের জন্য বাড়ির লোককে ওয়ার্ডে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। যার চিহ্ন হল গ্রিন কার্ড। কানিজ বেগমের ক্ষেত্রেও ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তিন জন গ্রিন কার্ড ব্যবহার করতেন বলে হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। ন্যাশনালের সুপার পার্থ প্রধান এ দিন বলেন, “হাসপাতাল থেকে কেউ ছাড়া পেয়ে বাড়ি গেলে নিরাপত্তারক্ষীরা ডিসচার্জ সার্টিফিকেট দেখেন। শিশুটি পুত্র না কন্যাসন্তান, তা-ও মিলিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু ভিজিটিং আওয়ার্সে এত ভিড়, এত ধাক্কাধাক্কি হয় যে, সব সময়ে নজর রাখা সম্ভব হয় না।” অর্থাৎ নজর রাখার ভার পরোক্ষে সেই বাড়ির লোকেরই উপরে বর্তাচ্ছে।
এ দিকে, হাসপাতালে মায়ের কোল থেকে সদ্যোজাত চুরির ঘটনাকে ‘মারাত্মক’ বলে অভিহিত করেছেন বিধানসভার স্বাস্থ্য বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য নির্মল মাজি। তাঁর মন্তব্য, “স্বাস্থ্যসচিব কী বলেছেন জানি না। বাম আমলের মন্ত্রীদের মতো এ ধরনের ঘটনায় উদাসীন বক্তব্য না-রেখে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া উচিত।” আইএমএ-র বঙ্গীয় শাখার সম্পাদক শান্তনু সেনের মতে, “অনেক আগে থেকেই শিশু চুরির একটা চক্র কাজ করছে। কোনও কিছু না-বলে তাদের ধরা দরকার। সেই লক্ষ্যেই নতুন সরকার নতুন উদ্যোগে কাজ
শুরু করেছে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.