দীপক গুহরায়এ বার শিক্ষক-নিগ্রহ নদিয়ার মদনপুর কেন্দ্রীয় আদর্শ বিদ্যালয়ে। ওই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষককে মারধরের ঘটনায় ‘অভিযুক্ত’ শাসক দল তৃণমূল।
অভিযোগ, ওই স্কুলের পরিচালন সমিতির (ঘটনাচক্রে, যা সিপিএমের দখলে) তৃণমূল সদস্য দিলীপ সাহা সহকারী প্রধান শিক্ষক দীপক কুমার গুহরায়কে সপাটে চড় মেরেছেন। সেই মর্মে দীপকবাবু পুলিশের কাছে অভিযোগও দায়ের করেছেন। দিলীপবাবুর পাল্টা বক্তব্য, তাঁকে শারীরিক ভাবে ‘নিগ্রহ’ করা হয়েছে। তিনিও পুলিশে এই অভিযোগ দায়ের করেছেন।
তৃণমূলের ওই স্থানীয় নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ, শনিবার স্কুল শুরুর পর কয়েক জন সঙ্গীকে নিয়ে স্কুলে ঢুকে তিনি ‘ফতোয়া’ দেন, ফেল-করা ছাত্রছাত্রীদের পাশ না-করালে দিনভর স্কুলে ‘বন্দি’ করে রাখা হবে শিক্ষকদের। স্কুলের সহ-শিক্ষকদের চাপে তখনকার মতো পিছু হটলেও তাঁদের ‘দেখে নেব’ বলে শাসিয়ে গিয়েছেন তিনি। স্কুলের শিক্ষকরা তেমনই অভিযোগ করেছেন।
দিলীপবাবুর অবশ্য দাবি, ঘটনাটিকে ‘রং চড়িয়ে’ দেখা হচ্ছে। তবে ফেল-করা ছাত্রছাত্রীদের পাশ করিয়ে দেওয়ার দাবি যে করেছিলেন, তা তিনি স্বীকার করেছেন। দিলীপবাবু বলেন, “আমি আদৌ ওই শিক্ষকের গায়ে হাত তুলিনি। আমি কয়েক জন অভিভাবককে নিয়ে স্কুলে গিয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম প্রতিটি ক্লাসে অন্তত ৩০ শতাংশ ছাত্র ফেল করেছে কেন। সকলকে পাশ করিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলাম আমি। উনি উল্টে আমাকে গালমন্দ করতে থাকেন। অপমানজনক কথা বলেন। এমনকী ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার চেষ্টাও করেন!” তাঁর দাবি, ‘ব্যাপারটা’ ওখানেই মিটে গিয়েছিল। তা হলে তিনি চাকদহ থানায় অভিযোগ দায়ের করলেন কেন? দিলীপবাবুর জবাব, “আমাকে মারধর করা হল, আর অভিযোগ করব না!” |
প্রত্যাশিত ভাবেই দিলীপবাবুর ‘পাশে’ দাঁড়িয়েছেন স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক নরেশ চাকি। দিলীপবাবু তৃণমূলের সদস্য নন, পরিচালন সমিতির নির্বাচনে তৃণমূলে তাঁকে ‘সমর্থন’ করেছিল জানিয়েও বিধায়কের বক্তব্য, “দিলীপবাবুকেই ঘুঁষি মারা হয়েছে বলে শুনেছি। উনি নিজেকে বাঁচাতে গিয়েছিলেন মাত্র। এতে দোষের কী আছে!”
শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনার নিন্দা করে শিক্ষাবিদ সুনন্দ সান্যাল বলেন, “কিন্তু নিন্দা করেও তো কাজ হচ্ছে না। কেউই তো শিক্ষা নিচ্ছেন না।” জাতীয় গ্রন্থাগারের অধিকর্তা স্বপন চক্রবর্তীও বলেন, “যে দলই করুক না কেন, এই ধরনের ঘটনাকে কড়া হাতে দমন করা উচিত।” আর, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক প্রশান্ত রায় সাফ বলছেন, “রাজ্যে ক্ষমতার হস্তান্তরের প্রভাব এ বার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতেও পড়ছে।”
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এ দিন বেলা ১১টা নাগাদ আচমকাই জনা কয়েক দলীয় সমর্থককে নিয়ে স্কুলে এসে হাজির হন দিলীপবাবু। স্কুলে তখন প্রথম পিরিয়ড চলছিল। স্কুলে থাকলেও নিজের ঘরে ছিলেন না প্রধান শিক্ষক উদয়ন সাহা। ক্লাস না-থাকায় সেই সময়ে নিজের ঘরে বসে ছিলেন সহকারী প্রধান শিক্ষক দীপকবাবু। তিনি বলেন, “দরজা খোলাই ছিল। দিলীপবাবু সোজা আমার কাছে এসে টেবিল চাপড়ে বলেন ঘরে বসে সময় কাটাচ্ছেন, ছেলেমেয়েরা ফেল করছে কেন, জবাব দিন! ওদের সবাইকে পাশ করিয়ে দিতে হবে!” তত ক্ষণে দিলীপবাবুর সঙ্গীরা ঘিরে ধরেছেন দীপকবাবুকে। সহকারী প্রধান শিক্ষক বলেন, “প্রথমে কিছুটা হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। আমি দিলীপবাবুকে জানাই, পাশ-ফেলের ব্যাপারটা তো আমার এক্তিয়ারে নেই। শুনে আরও চটে যান তিনি। এর পরেই চিৎকার করে ফেল-করা সব ছেলেমেয়েকে পাশ করিয়ে দেওয়ার দাবি জানাতে থাকেন। ওঁর অনুগামীরাও চেঁচাতে থাকেন।”
স্কুলের এক শিক্ষাকর্মী জানান, সহকারী প্রধান শিক্ষক দিলীপবাবুকে ‘শান্ত’ করার চেষ্টা করেন। তাঁকে জানান, আগামী ২১ জানুয়ারি পরিচালন সমিতির বৈঠক রয়েছে। দিলীপবাবু সেখানেই ওই দাবি তুলতে পারেন। তার পর বিষয়টি বচসা থেকে আরও গড়ায়। দীপকবাবুর দাবি, “প্রথমে আমাকে ঘাড়ধাক্কা দেন দিলীপবাবু। তার পর সপাটে এক চড় কষান।” চেঁচামেচি শুনে ছুটে আসেন সহ-শিক্ষকেরা। আসেন প্রধান শিক্ষক উদয়নবাবুও। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে হইচই করে ফিরে যাওয়ার আগে দিলীপবাবু শিক্ষকদের ‘দেখে নেব’ বলে শাসিয়ে গিয়েছেন বলে অভিযোগ।
এর পর আর ক্লাস হয়নি। এ দিন এমনিতেই আধ-বেলার স্কুল ছিল। কিন্তু ওই ঘটনার জেরে প্রথম পিরিয়ডের পরেই ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। উদয়নবাবু জানান, স্কুলে উত্তেজনা থাকায় পড়াশোনার পরিবেশ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তিনি বলেন, “দিলীপবাবু এর আগেও শিক্ষকদের উপরে চড়াও হয়েছেন। উনি নিজে যে পরিচালন সমিতিতে রয়েছেন, তা কী উনি বোঝেন না!” পরিচালন সমিতির সম্পাদক তপন বিশ্বাস বলেন, “দিলীপ সাহার এমন গুন্ডামির সঙ্গে স্কুলের শিক্ষকদের পরিচয় রয়েছে। এর আগে উনি প্রধান শিক্ষক উদয়নবাবুকেই মারধর করেছিলেন। বিষয়টি নিয়ে আমরা স্কুলশিক্ষা দফতরে অভিযোগ জানাব।” এ দিনের ঘটনার পরে উদয়নবাবু স্কুলের সব শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীকে নিয়ে থানায় গিয়ে দিলীপবাবুর বিরুদ্ধে সহকারী প্রধান শিক্ষককে মারধর করার অভিযোগ দায়ের করেন।
নদিয়া জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের চেয়ারম্যান তথা স্থানীয় বিধায়ক নরেশবাবুর অবশ্য বক্তব্য, “পরিচালন সমিতির নির্বাচন নিয়ে প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন দিলীপবাবু। তখন সহকারী প্রধান শিক্ষক এসে তাঁকে ঘুঁষি মেরে ঘর থেকে বের করে দেন। দিলীপবাবু নিজেকে বাঁচাতে গিয়েছিলেন মাত্র।” মদনপুরে তৃণমূলের অঞ্চল কমিটির সভাপতি কার্তিক ঘোষ বলেন, “প্রধান শিক্ষক স্কুলটাকে রাজনৈতিক আখড়া বানিয়ে ফেলেছেন। তারই প্রতিবাদ করছেন দিলীপবাবু। এ দিনও প্রতিবাদ করতে গিয়েই উনি শিক্ষকদের হাতে মার খেয়েছেন।”
গত ১০ ডিসেম্বর থেকে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনা ঘটছে। তার মধ্যে একটি ছাড়া সব ক’টি অভিযোগই শাসক-শিবিরের বিরুদ্ধে। নদিয়া জেলারই মাজদিয়া কলেজে অধ্যক্ষ-নিগ্রহে অভিযুক্ত সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআই। ঘটনাচক্রে, নদিয়ারই মদনপুরের ঘটনায় আবার শাসক তৃণমূলের নাম জড়িয়ে গেল। |