‘পিকনিক স্পট’ হাসপাতালের এক্স-রে বিভাগ!
গ্যাসের স্টোভ জ্বালিয়ে রান্নাবান্না ওই বিভাগেই।
খাদ্যতালিকায় মাংস। ভাত। তরকারি।
এবং ওই বিভাগের মধ্যেই পাত পেড়ে সেই খাবার খেলেন অন্তত ১৫ জন।
বৃহস্পতিবার স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন উপলক্ষে ছুটি ছিল। তার আগে, বুধবার রাতে এ ভাবেই হাসপাতালের এক্স-রে বিভাগে চড়ুইভাতি করলেন দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট জেলা হাসপাতালের কর্মীরা।
প্রতি বছরই শীতের সময় বিভিন্ন হাসপাতালে এমন পিকনিক হয়ে থাকে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের পরে বালুরঘাট হাসপাতালের কর্মীরা এ ভাবে বিভাগের মধ্যে গ্যাসের স্টোভ জ্বালিয়ে রান্না করার সাহস দেখালেন কী করে? বুঝতে পারছেন না জেলার স্বাস্থ্যকর্তারাও। ওই পিকনিকের জন্য সাত জন কর্মীকে শো-কজ করা হয়েছে। ওই বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক প্রণব ঠাকুর বাছারের ভূমিকা খতিয়ে দেখতে তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওই হাসপাতালের সুপার বুদ্ধদেব মণ্ডল। কলকাতা স্বাস্থ্য ভবন থেকে ঘটনার সবিস্তার রিপোর্ট চেয়ে পাঠানো হয়েছে।
ওই হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে যে এমন খাওয়াদাওয়ার চল রয়েছে, সুপারের বক্তব্যেই তা পরিষ্কার। তিনি বলেন, “বুধবার কয়েক জন এসে বলেন, রাতে তাঁরা খাওয়াদাওয়া করবেন। সাধারণত হোটেলের খাবার এনেই খাওয়া হয়। ভেবেছিলাম, তেমনটাই হবে। কিন্তু গ্যাস জ্বালিয়ে যে রীতিমতো ভোজের আয়োজন করা হবে, তা ধারণা করতে পারিনি। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তবে এক্স-রে বিভাগের টেকনিশিয়ান, শো-কজের চিঠি পাওয়া বিনয় শীলের দাবি, “আমরা যা করেছি সুপারকে জানিয়েই করেছি। বিভাগের এক কোণে রান্না করেছি। এতে কোনও ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা ছিল না।”
ওই টেকনিশিয়ান যা-ই বলুন, যেখানে বুধবার রাতে গ্যাসের স্টোভ জ্বালিয়ে রান্না হয়েছে, সেই জায়গাটি অত্যন্ত বিপজ্জনক। এক্স-রে বিভাগের পাশেই হাসপাতালের মেডিসিন স্টোর্স। রেডিওলজি বিভাগও প্রায় গা ঘেঁষে। |
কোনও দুর্ঘটনা ঘটে গেলে বড় বিপদ হতে পারত বলে মনে করছেন হাসপাতালের প্রশাসকেরা। বুধবার রাতে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, মাংস রান্নার সঙ্গে সঙ্গে ভাত-তরকারি রান্নার আয়োজনও চলছে জোর কদমে। সাংবাদিকেরা পৌঁছতেই আড়ালে চলে যান উদ্যোক্তারা। রাতেই খবর পেয়ে হাসপাতালের সুপারকে তদন্তের নির্দেশ দেন জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক। বৃহস্পতিবার জেলা পরিষদের সভাধিপতি মাগদালিনা মুর্মু এবং মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক হাসপাতালে গিয়ে অভিযুক্তদের ভর্ৎসনা করেন।
জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে বলা হয়, গঙ্গারামপুর মহকুমা হাসপাতালের দোতলায় গত বছর শীতের সময় নার্সেরা পিকনিকের আসর বসিয়েছিলেন। রান্না চলাকালীন হঠাৎই হাসপাতালের আসবাবে আগুন ধরে যাওয়ায় হইচই পড়ে যায়। সে-বারেও কয়েক জনকে শো-কজ করা হয়েছিল। কিন্তু তার থেকে বড় কোনও শাস্তি দেওয়া হয়নি অভিযুক্তদের কাউকেই। জেলার সব হাসপাতালকেই এ ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে যে কোনও ফল হয়নি, বালুরঘাটের ঘটনাই সেটা প্রমাণ করে দিল। স্বাস্থ্য ভবনের এক কর্তার মন্তব্য, গত বছরের ঘটনায় অভিযুক্ত নার্সদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে বালুরঘাট হাসপাতালের কর্মীরা হাসপাতালে ওয়ার্ডের মধ্যে এ ভাবে রান্নার করার সাহস পেতেন না।
বালুরঘাট জেলা হাসপাতালে সদ্য যোগ দিয়েছেন রেডিওলজিস্ট বিমলেশ জি বিমল। হাসপাতাল সূত্রের খবর, খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হয়েছিল তাঁর টাকাতেই। তিনি বলেন, “হাসপাতালের কয়েক জন কর্মী আমাকে ধরেছিলেন খাওয়ানোর জন্য। টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই খাওয়াদাওয়ার আয়োজনটা যে হাসপাতালের ভিতরেই এক্স-রে বিভাগে হবে, সেটা কেউ আমাকে বলেননি।” বুধবার রাতে ওই ভূরিভোজে আরও অন্তত ১৫ জন ছিলেন বলে জেলার স্বাস্থ্যকর্তারা জানতে পেরেছেন।
জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অসিত মণ্ডল বলেন, “সরাসরি যে-সাত জনকে চিহ্নিত করা গিয়েছে, তাঁদের (বিনয় শীল, সুভাষ সরকার, বিপুল দাস, শুক্লা কুণ্ডু, দুলাল সরকার, ইসমাইল-সহ সাত জন) শো-কজ করেছি। বাকি অভিযুক্তদের ভূমিকা যাচাইয়ে সুপারকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” আমরির ঘটনার পরে হাসপাতালগুলিতে অগ্নি নির্বাপণের যথাযথ ব্যবস্থা চালু করতে রাজ্য সরকার তৎপর। সেই সময়েই স্বাস্থ্যকর্মীদের একাংশের এই আচরণে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বিধায়ক তথা কারামন্ত্রী শঙ্কর চক্রবর্তী। তিনি বলেন, “বিষয়টি খুবই গুরুতর। জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিককে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলেছি।” |