রাজস্থানের জয়পুরে অনুষ্ঠেয় সাহিত্য সম্মেলনে সলমন রুশদির যোগ দিতে আসার বিরুদ্ধে মৌলবাদী সংগঠনগুলি মুখর হইয়াছে। দেওবন্দের দারুল উলুম প্রথম এ সংক্রান্ত প্রতিবাদটি উচ্চারণ করে। অতঃপর অন্যান্যরা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, মুসলিম রাজনীতিক ও মন্ত্রীরা, এমনকী সাহিত্য সম্মেলনে আমন্ত্রিত লেখক চেতন ভগৎও রুশদিকে ভারতে আসার অনুমতি না দিতে সরকারকে অনুরোধ করিয়াছেন। রুশদি সম্পর্কে অভিযোগ তিনি মুসলিমদের ধর্মীয় আবেগে আঘাত করিয়াছেন। অভিযোগটি পুরানো। এই অভিযোগে ইরানের প্রয়াত ইমাম আয়াতোল্লা রুহোল্লা খোমেইনি রুশদির বিরুদ্ধে একদা মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া পর্যন্ত জারি করিয়াছিলেন। পরে ইরান সরকারি ভাবে সেই ফতোয়া প্রত্যাহার করিয়া লয়। কিন্তু ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের একাংশের প্রতিবাদে তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকার রুশদির বিতর্কিত উপন্যাস ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ নিষিদ্ধ করিয়া দেয়। তাহার পর যমুনা দিয়া অনেক জল গড়াইয়া গিয়াছে। রুশদি একাধিক বার ভারতে আসিয়াছেন। তখন তাঁহার আগমন বা অবস্থিতি লইয়া কোনও প্রতিবাদী কণ্ঠ শোনা যায় নাই। এখন কেন নূতন করিয়া এই সমস্বর কোলাহল?
কারণটি আর কিছুই নয় উত্তরপ্রদেশে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলই ‘মুসলিম ভোট’ নিজের দিকে টানিতে ব্যগ্র। রাজনীতিকদের সেই ব্যাকুলতা দেখিয়াই দারুল উলুমও ঝোপ বুঝিয়া কোপ মারিয়াছে। দেওবন্দের এই ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র হইতে এত কাল রুশদি সম্পর্কে কোনও মন্তব্য শোনা যায় নাই। নির্বাচনে বিষয়টিকে লইয়া জল ঘোলা করাই তাহাদের ফতোয়ার উদ্দেশ্য। সেই ঘোলা জলে মাছ ধরিতে রাজনীতিকরা এতই উৎসাহী যে, এমনকী বিজেপির সংখ্যালঘু সেল-এর তরফেও রুশদিকে ভারতে আসিতে না দেওয়ার দাবি তোলা হইতেছে। দাবিদারদের তালিকায় তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা, কেন্দ্রীয় পর্যটন দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী সুলতান আমেদকেও দেখা যাইতেছে। সুখের কথা, সলমন রুশদির মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমনের এই সম্মিলিত আগ্রহে কেন্দ্রীয় সরকার যোগ দেয় নাই। দৃঢ়তার সহিত জানাইয়া দিয়াছে যে, এই দাবি মানার কোনও প্রশ্নই নাই। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায় দায়বদ্ধ একটি রাষ্ট্রে এই দৃঢ়তা অত্যাবশ্যক ছিল। দাবিদারদের মনে রাখা উচিত, ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এখানে ধর্মাচরণের স্বাধীনতা শিরোধার্য, কিন্তু ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকারও শিরোধার্য। কারণ ভারত একটি গণতন্ত্র।
এই গণতন্ত্র দাঁড়াইয়া আছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর। মত অপছন্দ হইলে তাহার বিরুদ্ধ মত প্রকাশ বা প্রচার করা যাইতে পারে, কিন্তু মতপ্রকাশের অধিকার কাড়িয়া লওয়া যায় না। গণতন্ত্রের মূল ভাবনাই হইল বহুত্ববাদ, রকমারি মত পোষণ ও প্রকাশের স্বাধীনতা। কাহারও ধর্মবিশ্বাসে আঘাত লাগে, এমন কিছু না করাই শ্রেয়, কিন্তু কেহ তাহা করিলে তাঁহাকে বলিতে, লিখিতে, ছবি আঁকিতে বা গান গাহিতে রাষ্ট্র নিষেধ করিতে পারে না। প্রায়শ সাম্প্রদায়িক অশান্তির আশঙ্কা দেখাইয়া মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কাড়িয়া লওয়ার যুক্তি শোনা যায়। মনে রাখা দরকার, ধর্মীয় আবেগ আহত হইলে কোনও সম্প্রদায় আপনিই তরবারি লইয়া রাস্তায় নামিয়া পড়ে না, তাহাদের উস্কানি দিয়া ধর্মব্যবসায়ী কায়েমি স্বার্থচক্রীরা দাঙ্গা লাগায়। গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ব্যক্তিগত প্রার্থনা, উপাসনা ও আচরণের বিষয়। রাষ্ট্রের সেখানে কোনও ভূমিকা নাই। পক্ষেও নহে, বিপক্ষেও নহে। |