প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ভারতের বিপুল শিশু-অপুষ্টিকে ‘জাতির লজ্জা’ বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন। পাঁচ বৎসরের অনধিক শিশুদের মধ্যে ৪২ শতাংশ অপুষ্টির হারের খবরটি নূতন নহে, এবং ভারতে শিশু-অপুষ্টি যে আফ্রিকার দরিদ্রতর দেশগুলিকেও লজ্জা দেয়, এ কথাও অমর্ত্য সেন প্রমুখ নানা বিশেষজ্ঞ বারংবার বলিয়াছেন। তবু প্রধানমন্ত্রীর স্বীকৃতির একটি বিশেষ তাৎপর্য রহিয়াছে। তাহা বুঝাইয়াছে যে, রাজনৈতিক দায় এড়াইবার খেলা শেষ, কেবল পরিসংখ্যান শুনাইয়া পার পাইবার রাস্তা নাই। ভারত যে শিশুদের পুষ্টিবিধানের মৌলিক কাজটিতে ব্যর্থ হইয়াছে, তাহা স্বীকার করার প্রয়োজন ছিল। ইহাতে পুষ্টির বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব পাইবে, দরিদ্র পরিবারের একটি দীর্ঘ দিনের সমস্যা জাতির সমস্যা বলিয়া অনুভূত হইবে। দ্বিতীয়ত, ইহার ফলে নূতন করিয়া চিন্তা করিবার প্রয়োজনটি অনুভূত হইবে। যে পদ্ধতিতে ক্ষুধা নিবারণ এবং পুষ্টি বিধানের প্রচেষ্টা হইয়াছিল, সেগুলি কেন কাজ করে নাই, তাহাদের সংশোধনের প্রয়োজন রহিয়াছে, না কি নূতন পরিকল্পনা লইতে হইবে, তাহা লইয়া চিন্তার সুযোগ তৈরি হইয়াছে।
এই নূতন চিন্তার প্রথমেই মনে রাখিতে হইবে, পুষ্টির সমস্যাটি জটিল ও বহুমাত্রিক। সমাজের নানা স্তরে তাহার চিত্র আলাদা। শিশু-অপুষ্টির গড় হার ৪২ শতাংশ হইলেও, জনজাতি-দলিতদের মধ্যে তাহার হার অনেক বেশি। অতএব সামাজিক বঞ্চনা এবং দারিদ্রের সহিত অপুষ্টির যোগ রহিয়াছে। কিন্তু ক্ষুধাই অপুষ্টির একমাত্র কারণ নহে, মধ্যবিত্ত এবং ধনী পরিবারেও অপুষ্টি যথেষ্ট রহিয়াছে বলিয়াই গড় হার এত বাড়িয়াছে। ইহার অর্থ, খাদ্য নিরাপত্তা বিল পাশ করিয়া, সুলভে প্রচুর খাদ্যশস্য সরবরাহ করিলেই অপুষ্টির সমস্যা লাঘব হইবে, তাহা ধরিয়া লওয়া চলে না। পানীয় জল, শৌচাগারের ব্যবস্থা, পয়ঃপ্রণালী, প্রভৃতি হইতে পেটের রোগ উদ্ভূত হয়, যাহা খাদ্যের পুষ্টিগুণকে দেহ হইতে বাহির করিয়া দেয়। শহর ও গ্রামের বহু জনবসতিতে পরিবারগুলি সম্পন্ন হইলেও তাহারা বাস করে অতিশয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। এই সকল স্থানে পরিস্রুত জল এবং পাকা শৌচাগারের ব্যবস্থা না করিয়া, কেবল রেশন দোকান খুলিয়া পুষ্টিবিধান সম্ভব নহে। শিশুদের শরীরে ব্যাপক হারে কৃমির প্রবেশও অপুষ্টির এক প্রধান কারণ। নানা দেশে সমীক্ষায় দেখা গিয়াছে, বৎসরে মাত্র দুই বার স্কুলছাত্রদের কৃমির ঔষধ খাওয়াইয়া তাহাদের স্বাস্থ্যে উন্নতি হইয়াছে, তাহাদের রোজগারেও তাহা ধরা পড়িয়াছে। বিশ্বের বহু দেশে এখন কৃমিনাশ প্রকল্পকে জনস্বাস্থ্য প্রকল্প বলিয়াই ধরা হইতেছে। ভারতেও কয়েকটি রাজ্যে ইহা শুরু হইয়াছে।
শিশুর স্বাস্থ্য ও পুষ্টিতে যে হেতু তাহার মায়ের একটি প্রধান ভূমিকা থাকে, অতএব কোন খাদ্য কত পরিমাণে খাওয়ানো প্রয়োজন সেই বিষয়ে মায়েদের সচেতন করিতে হইবে, এমন একটি দাবিও উঠিয়াছে। এই দাবি ক্রমশ জোরালো হইবে। স্বল্পশিক্ষিত গৃহবধূ কিছুই বোঝেন না, অতএব তাঁহাদের বুঝাইবার জন্য সরকারি অর্থে বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করিবার আগ্রহ দেখা দিবে, বহু অসরকারি সংস্থা প্রকল্প তৈরি করিবে, এমনই প্রত্যাশিত। কিন্তু তাহাতে লাভ বড় একটা হইবে না। স্বাস্থ্য সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞানের পরিবর্তে মূলস্রোতের স্কুলশিক্ষা যে মেয়েদের এবং তাহাদের সন্তানদের স্বাস্থ্যে অধিক পরিবর্তন আনে, তাহা প্রমাণিত হইয়াছে। মায়ের স্কুলশিক্ষার প্রতিটি অতিরিক্ত বৎসর তাহার সন্তানের স্বাস্থ্য-পুষ্টিতে প্রতিফলিত হইয়া থাকে। সুতরাং কিশোরীদের বিদ্যালয়ের পাঠ সমাপ্ত করিবার সুযোগ তৈরি করা হইল শিশুপুষ্টি নিশ্চিত করিবার প্রধান ও সর্বাধিক কার্যকর উপায়। শিশুপুষ্টির মূলে রহিয়াছে নারীশিক্ষা, ভুলিলে চলিবে না। |