ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে আজ একটি নতুন মাইলফলক রচনা করল ত্রিপুরা।
দু’দিনের সফর শেষে যখন সন্ধ্যায় দেশে ফেরার বিমান ধরছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তত ক্ষণে তাঁর পিতার অসমাপ্ত কাজটি সফল ভাবে সমাপ্ত। গোটা দিন ধরে, বিভিন্ন মঞ্চে, ভারত তথা ত্রিপুরার মানুষকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন হাসিনা। বলেছেন, চল্লিশ বছর পার হয়ে গেলেও তিনি ভুলতে পারেন না যে মুক্তিযোদ্ধা এবং উদ্বাস্তুদের কী ভাবে ‘খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তা ও চিকিৎসা’ দিয়েছিল আগরতলা। আর এই স্মৃতি তর্পণের পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অবলীলায় জয় করে নিয়েছেন রাজ্যবাসীর হৃদয়। রাস্তায় অথবা বিবিধ মঞ্চে অপেক্ষমান হাজারো মানুষকে বার্তা দিয়েছেন, ‘আমি তোমাদেরই লোক’।
ত্রিপুরার দক্ষিণে পালাটানা বিদ্যুৎপ্রকল্পে বিনিয়োগের ইচ্ছা প্রকাশ থেকে ফেনি নদীর উপরে সেতু গড়া, আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহার, সীমান্ত হাটগুলি খোলা অথবা বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাণিজ্য বিস্তার সব ক্ষেত্রেই ত্রিপুরা সরকারের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন হাসিনা। বিদেশ মন্ত্রকের কর্তাদের মতে, তিস্তা-বিতর্ককে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে যে বরফ জমেছিল, এই সফরের উষ্ণতা তার অন্তত কিছুটা হলেও গলিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। এই সফর, দু’দেশের ভবিষ্যৎ কূটনীতিতে তাই যথেষ্ট ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেই মনে করছে বিদেশ মন্ত্রক। বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী দীপু মণিও একই সুরে বলেছেন, “আজ দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কে যে নতুন দিগন্ত রচিত হল, তাকে কাজে লাগাতে হবে। সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক।” |
ঠিক কী ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় দু’দিনে তৈরি হওয়া এই ‘নতুন দিগন্ত’?
গত কাল যখন হাসিনা এলেন এখানে, সেই প্রথম কোনও বিদেশি বিমান নামল আগরতলা বিমানবন্দরে। আজ অসম রাইফেলস-এর মাঠে হাসিনার গণসর্ম্বধনায় যে বিপুল জনসমাবেশের সাক্ষী থাকল আগরতলা, সেটিও কি প্রথম নয়?
ভিড় হয়তো এর আগেও অনেক হয়েছে। কিন্তু এমন দলমতনির্বিশেষ বাঁধভাঙা স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ? উত্তর খুঁজতে ইতিহাস ঘাঁটতে হবে। আজ সকালে ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্মানিক ডিলিট দেওয়া হল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে। যেখানে এই তথ্য জেনে রীতিমতো শিহরিত নেত্রী, যে এখন যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় ভবন, চল্লিশ বছর আগে সেটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শিবির! এমনকী, এখানে খানসেনাদেরও আগ্রাসন ঘটেছে, পরিণামে রক্তপাতও। দৃশ্যতই আবেগরুদ্ধ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্চে লিখিত ইংরেজি বক্তৃতা থেকে সরে এসে সটান বাংলায় বললেন, “আমার প্রথম সন্তান যখন জন্ম নেয়, তখন আমি জেলখানায়। যে অমানবিক নির্যাতন আমাদের উপর হয়েছিল, তা আজ বিশ্ববাসী জানেন। কিন্তু সেই সময় আপনারা যে সহযোগিতা করেছিলেন, তার কথা কখনও ভুলতে পারি না। যে সম্মান আজ বিশ্ববিদ্যালয় দিল, আমি তার যোগ্য কি না, তাও জানি না। বহু চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে জীবন কাটাতে হয়েছে, লেখাপড়াও বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আমার গৌরবের শেষ নেই। কেন না এক সময় মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন এখানে।”
রাজ্যের অতিথিশালা (যেখানে তিনি ছিলেন) থেকে শুরু করে গত দু’দিনে হাসিনা যখন যেখানে গিয়েছেন, সব রকম মানুষের ভিড় উপচে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে কাতারে মানুষ অপেক্ষা করেছে শুধু তাঁকে এক ঝলক দেখার জন্য। অভিভূত হাসিনা বিনিময়ে বলেছেন, “মহান মুক্তিযুদ্ধের তীর্থভূমিতে দাঁড়িয়ে সবাইকে ধন্যবাদ। বাংলাদেশ-ভারতের মৈত্রী সুদৃঢ় হোক। ত্রিপুরার সঙ্গে বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হোক, এটাই আমি চাই।” আর এই ‘গাঢ় বন্ধুত্বের’ প্রশ্নে সাড়া দিয়েছেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারও। আজ গণসম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে মানিকবাবু জানিয়েছেন, কেন্দ্রের যদি কোনও আপত্তি না থাকে, তা হলে তাঁদের পালাটানা প্রকল্পের উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ ঢাকাকে দিতে তাঁর সরকার প্রস্তুত। সে ক্ষেত্রে ১০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ দেওয়া যেতে পারে বাংলাদেশকে। এই ঘোষণায় উৎসাহিত হাসিনার পাল্টা বক্তব্য, শুধু ১০০ মেগাওয়াট কেন, পালাটানায় আর্থিক বিনিয়োগ করতে চায় তাঁর দেশ। ফলে সেখানে আরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। লাভবান হবে দুই দেশই। ত্রিপুরায় মঞ্চে দাঁড়িয়েই আজ হাসিনা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ভারতকে ‘সাহায্য’ করার জন্য তাঁকে ঘরোয়া রাজনীতিতে চাপের মুখে থাকতে হচ্ছে। বিরোধী জোট বিএনপি-জামাত তাঁর এই পদক্ষেপগুলিকে মোটেই ভাল চোখে দেখছে না। তাঁর কথায়, ‘পালাটানা প্রকল্পে ত্রিপুরাকে সাহায্য করার জন্য, বিরোধী দল যথেষ্ট গালমন্দ করছে। কিন্তু পড়শি দেশ অসুবিধায় পড়লে, সাহায্য করব না, এ তো হতে পারে না।’ কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রসঙ্গটি তুলে ধরে হাসিনা ভারতীয় নেতৃত্বকে বার্তা দিয়েছেন যে, তাঁর পথও যথেষ্ট বন্ধুর। তিনি যতটা পারেন ভারতের জন্য দরজা খুলছেন, কিন্তু তিস্তার মতো বিষয়টি নিয়ে ভারতকেও পাল্টা সাহায্য করতে হবে। |
ত্রিপুরার দীর্ঘদিনের দাবি, বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে (ট্রানজিট) উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পণ্য পরিবহণের বিষয়টি চূড়ান্ত হোক। এ বারের আলোচনায় বিষয়টি অনেকটা এগিয়েছে। ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বক্তৃতায় ‘সংযোগের’ বিষয়টির উপর বাড়তি জোর দিয়েছেন হাসিনা। ২০১০ সালে তাঁর নয়াদিল্লি সফরের সময় বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল, সে কথা স্মরণ করিয়ে আজ হাসিনা বলেছেন, “আমার এ নিয়ে সন্দেহ নেই যে, ত্রিপুরা-সহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সংযোগ বাড়ালে বিশাল অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত গড়ে উঠবে। সাধারণ মানুষের হাত শক্ত হবে, গোটা অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন এবং বিকাশ ঘটবে। দক্ষিণ এশিয়াকে শান্তিপূর্ণ রাখাও সম্ভব হবে।”
|