প্রথমে শীর্ষ আদালতের সঙ্গে টানাপোড়েন। তার পরে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি সংঘাত। জোড়া এই সঙ্কটে পাকিস্তানে যখন সেনা অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, ঠিক তখনই দুবাই পাড়ি দিলেন প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি।
এর মধ্যে পাক সুপ্রিম কোর্ট আজ প্রেসিডেন্টের উপরে চাপ আরও বাড়িয়ে তাঁর বিরুদ্ধে আগামী সোমবার একটি দুর্নীতি-মামলার শুনানির দিন ধার্য করেছে। এর আগে গিলানিকে অসৎ বলে কোর্ট ভর্ৎসনা করেছিল। শুনানির দিন ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পরেই সেনার উচ্চ পর্যায়ের কম্যান্ডারদের সঙ্গে রাওয়ালপিন্ডিতে সেনার সদর দফতরে বৈঠক করেন সেনাপ্রধান আশফাক পারভেজ কিয়ানি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পাক সেনা অফিসার এই খবর দিয়ে জানান, দেশের নিরাপত্তা এবং বিদেশনীতি যাঁরা ঠিক করেন, সেই জেনারেলরাও এই বৈঠকে ছিলেন। শাসক জারদারিকে নিয়ে তাঁরা হতাশ। তাই প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করে পাক সেনা ফের শাসকের ভূমিকা নেবে কি না, সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
তবে ওই পাক অফিসারের দাবি, সেনা-অভ্যুত্থান নিয়ে বৈঠকে কোনও কথা হয়নি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও মনে করছেন, অভ্যুত্থান করে সুপ্রিম কোর্টের বিরাগভাজন হতে চাইবে না পাক সেনা। পাক সংবাদমাধ্যমও সেনাকে অনুরোধ করেছে, তারা যেন ফের অভ্যুত্থানের কথা না-ভাবে। দেশের প্রথম সারির একটি সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়তে আজ বলা হয়েছে, ‘দশ-পনেরো বছর আগে হলে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গিলানির মন্তব্যে অভ্যুত্থান হতেই পারত। তবে সংবাদমাধ্যমের কঠোর ভূমিকা এবং সুপ্রিম কোর্টের সক্রিয়তায় সেনার হস্তক্ষেপ অনেকটাই কমেছে’।
পাকিস্তানে সেনা-অভ্যুত্থান নিয়ে জল্পনা প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে পেন্টাগনের মুখপাত্র জন কার্বি দাবি করেন, অভ্যুত্থান হবে না পাক সেনা এমন কোনও আশ্বাস মার্কিন প্রশাসনকে দেয়নি। সরকার এবং সেনা পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সঙ্কট মোকাবিলা করবে বলে আশা পেন্টাগনের। কার্বি জানান, জয়েন্ট চিফ্স অফ স্টাফ-এর চেয়ারম্যান জেনারেল মার্টিন ই ডেম্পসির সঙ্গে ফোনে কিয়ানির কথাও হয়েছে। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাতে চাননি তিনি। পেন্টগনের বক্তব্য, সন্ত্রাস প্রশ্নে তারা আগামী দিনেও পাক সেনার সঙ্গে ‘স্বাভাবিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ’ সম্পর্কই বজায় রাখতে চায়।
এই টালমাটাল সময়ে জারদারির দেশ-ত্যাগ নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই শুরু হয়েছে বিতর্ক। যদিও সরকারি ভাবে দাবি করা হচ্ছে, এক আত্মীয়ের বিয়েতে যোগ দিতে দুবাই গিয়েছেন জারদারি। একটি সূত্রের আবার দাবি, এ বারও চিকিৎসার জন্য দুবাই গিয়েছেন প্রেসিডেন্ট। আগামিকালই ফিরবেন। প্রশাসন সূত্রের বক্তব্য, প্রেসিডেন্টের এই সফরের সঙ্গে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কোনও সম্পর্ক নেই। জারদারির বিরুদ্ধে দুর্নীতি-মামলা ফের শুরু করতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ নিয়ে আলোচনা করতে ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লিতে আজ জরুরি অধিবেশন ডাকেন প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি।
বিশ্লেষকদের ধারণা, শীর্ষ আদালত গিলানি-জারদারির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করলে দেশে নির্বাচন এগিয়ে আসতে পারে। ভোট এগিয়ে আনার পক্ষে সওয়াল করে আজ গিলানি-জারদারির পদত্যাগ দাবি করেন তেহরিক-ই-ইনসাফ-এর প্রধান ইমরান খান। তিনি বলেন, “আমরা সেনা-অভ্যুত্থানের পক্ষে নই। মানুষও একনায়কদের চায় না। ওরা ক্ষমতা থেকে সরে যাক। অবাধ, স্বচ্ছ নির্বাচন হোক।” এর মধ্যেই পাক নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ১০০ সদস্যের সেনেটের ৫০টি আসনের জন্য ভোট হবে ২ মার্চ।
সেনা-সরকার বিতণ্ডার শুরু দিন তিনেক আগে। স্মারকলিপি-বিতর্কে (মেমোগেট) সরকারের অনুমতি ছাড়াই সেনাবাহিনী সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা জমা দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হন গিলানি। তিনি এই কাজকে ‘অবৈধ’ ও ‘সংবিধানবিরোধী’ বলেন। তাতে ক্ষুব্ধ সেনা গত কাল এক বিবৃতিতে বলে, “ওই মন্তব্যের ফল সুদূরপ্রসারী ও মারাত্মক হতে পারে।” এর কয়েক ঘণ্টা পরেই কিয়ানি-ঘনিষ্ঠ প্রতিরক্ষাসচিব খালিদ নাইম লোধিকে বরখাস্ত করেন গিলানি।
প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তে ক্ষোভ বাড়ে সেনার। লোধির সঙ্গে গিলানির সম্পর্ক তিক্ত হয়েছিল স্মারকলিপি-বিতর্কের সময়েই। এক সেনা-অফিসার জানিয়েছেন, মেমো-প্রশ্নে কিয়ানি ও আইএসআই প্রধান সুজা পাশার দেওয়া বিবৃতির বিরোধিতা করতে সরকারের তরফে চাপ দেওয়া হয় লোধিকে। কিন্তু লোধি রাজি হননি। একটি মার্কিন দৈনিকের দাবি,
আজ পাক সেনা হুমকি দিয়েছে, নয়া প্রতিরক্ষাসচিবের সঙ্গে সহযোগিতা করবে না তারা। আজই আবার লোধিকে বরখাস্তের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে লাহৌর হাইকোর্টে। এই অবস্থায় দেশের প্রধান শাসক দল পিপিপি সেনার সঙ্গে সরকারের সমন্বয় সাধনে অনুরোধ জানিয়েছে তাদেরই শরিক পিএমএল-কিউ-এর প্রধান চৌধুরি সুজাত হুসেনকে। পারভেজ মুশারফের জমানায় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সুজাত। সেনার শীর্ষ অফিসারদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতাও রয়েছে। সেনা-সরকার দ্বন্দ্ব মেটাতে তিনি কী করেন, সেটাই এখন দেখার। |