কাটোয়ায় প্রস্তাবিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে জমি কেনার প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে এনটিপিসি। এর জন্য প্রয়োজনে চাষিদের বাড়ি বাড়ি যাবেন সংস্থার কর্মীরা। বিনিয়োগ করা হবে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। এই প্রকল্পের জন্য রাজ্য সরকার আগে যে দরে জমি অধিগ্রহণ করেছিল, মোটামুটি তা-ই দেওয়া হবে বলেও স্থির হয়ে গিয়েছে।
ফলে, রাজ্যে শিল্প গড়তে গেলে শিল্পোদ্যোগীদেরই জমি কিনতে হবে বলে যে নীতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়েছেন, এনটিপিসি-র এই উদ্যোগের মধ্যে দিয়ে তারই পরীক্ষা শুরু হয়ে গিয়েছে।
দু’দিন আগেই কলকাতায় ‘বেঙ্গল লিড্স’ শীর্ষক শিল্প সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, জমি অধিগ্রহণ করে না দিলেও প্রয়োজনে সরকার সব রকম সহায়তা করবে। কিন্তু কী কী ভাবে সেই ‘সহায়তা’ করা হবে তা ব্যাখ্যা করা হয়নি। ফলে শিল্পপতিরাও বিশেষ ‘আশ্বস্ত’ হতে পারেননি। কেননা যে রাজ্যে বড় জমিমালিক প্রায় নেই, সিংহভাগ জমি ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষিদের হাতে ছড়িয়ে রয়েছে, সেখানে সরকারের সাহায্য ছাড়া এক লপ্তে বড় জমি কেনা নিয়ে শিল্পমহলের সংশয় রয়েছে। |
বুধবারই কলকাতায় ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিৎজ মন্তব্য করেন, শুধু পশ্চিমবঙ্গ কেন, সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়া পৃথিবীর কোনও প্রান্তেই শিল্পের জন্য জমি পাওয়া সম্ভব নয়। পূর্বতন বাম সরকারের কর্ণধার বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-নিরুপম সেনরাও এত দিন এই সওয়ালই করে আসছিলেন। এমনকী জমি আন্দোলনের ধাক্কায় সরকার থেকে ছিটকে যাওয়ার পরেও বামেরা সেই বক্তব্যে অনড়।
ইতিমধ্যেই জমির অভাবে পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে জয় বালাজি, বর্ধমানের জামুড়িয়ায় ভিডিওকন, সালানপুরে ভূষণ স্টিলের মতো বেশ কিছু প্রকল্পের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বিশেষত, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পরবর্তী পর্বে চাষিরা জমি নিয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি ‘স্পর্শকাতর’। তাঁদের ভাবাবেগকে ব্যবহার করে যথেষ্ট ‘রাজনীতি’ হয়েছে এবং আরও হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তা ছাড়া, সরকার হস্তক্ষেপ না করলে দালালেরা জমি কেনা-বেচায় ঢুকে পড়বে, এই আশঙ্কাও এড়ানো যাচ্ছে না।
পূর্বতন বাম সরকারই বর্ধমানের কাটোয়ায় এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৫৫২ একর জমি অধিগ্রহণ করে রাজ্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের (পিডিসিএল) হাতে তুলে দিয়েছিল। তার পরে অর্থাভাবে কাজ থমকে যাওয়ায় পিডিসিএল-এর হাত থেকে প্রকল্পের ভার নেয় জাতীয় তাপবিদ্যুৎ নিগম (এনটিপিসি)। প্রকল্প গড়তে আরও অন্তত ৫০০ একর জমি প্রয়োজন। কিন্তু জমি আন্দোলনকে পুঁজি করে রাজ্যে ক্ষমতায় এসেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দেন, শিল্পের জন্য সরকার আর জমি অধিগ্রহণ করবে না। শিল্প সংস্থাকেই সরাসরি তা কিনে নিতে হবে। বৃহস্পতিবার ঝাড়গ্রামে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সেই অবস্থানই কার্যত ফের স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে প্রথমে পিছু হটার কথা ভাবলেও পরে নিজেরাই জমি কেনার সিদ্ধান্ত নেয় এনটিপিসি। সংস্থার আঞ্চলিক অধিকর্তা (পূর্বাঞ্চল ১) উমেশপ্রসাদ পানি বলেন, “এজেন্ট বা আর কারও মাধ্যমে নয়, আমরাই সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে জমি কিনব। এর আগে পিডিসিএল যে মূল্যে জমি নিয়েছে, আমরা সেটাই অনুসরণ করব।” বুধবারই কাটোয়ার শ্রীখণ্ডে গিয়ে সংস্থার জেনারেল ম্যানেজার রামানুজ মিশ্র ও অন্য পদস্থ কর্তাদের সঙ্গে প্রথম ‘প্রকল্প উন্নয়ন বৈঠক’ করেছেন তিনি।
এনটিপিসি যে ভাবে জমি কেনার পরিকল্পনা করছে, তাতে আপাত ভাবে দালালদের বিশেষ সুবিধা হওয়ার কথা নয়। ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর থেকে জমিমালিকদের নাম-ঠিকানা চেয়ে নেওয়া হয়েছে। সংস্থার জেনারেল ম্যানেজার রামানুজ মিশ্র বলেন, “আমরা চাষিদের কাছে চিঠি পাঠাব। তাঁরা এসে সরাসরি আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন। প্রয়োজনে আমাদের কর্মীরা বাড়ি-বাড়ি যাবেন।” হিসেব চূড়ান্ত না হলেও কমবেশি ১৫০০ থেকে ১৮০০ চাষির জমি কিনতে হবে তাঁদের। সেটা যে মুখের কথা নয়, তা অবশ্য কর্তারাও জানেন।
তবে দু’টি বিষয় এনটিপিসি-কে সুবিধা দিতে পারে বলে ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা। প্রথমত, জমি দেওয়া নিয়ে চাষিদের যে প্রাথমিক আপত্তি ছিল তার নিষ্পত্তি প্রথম দফায় সরকারি অধিগ্রহণের সময়ে হয়েছে। স্থির হয়ে গিয়েছে জমির দর। অধিগৃহীত ৫৫২ একর জমির মালিকেরা চেক নিয়ে নেওয়ায় ‘কৃষি, কৃষক ও খেতমজুর বাঁচাও কমিটি’ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছে ও ভেঙেও দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, সম্প্রতি একের পর এক চাষে বিপর্যয়ের পরে চাষিদের অনেকেই বুঝছেন, জমি আঁকড়ে থেকে তাঁরা বাঁচবেন না। শিল্পায়ন ছাড়া গতি নেই।
পিডিসিএল-এর করা মানচিত্র অনুযায়ী শ্রীখণ্ডে ১৩৫ একর, চুড়পুনিতে ৬৬ একর ও জাজিগ্রামে ২৩৫ একর জমি নেবে এনটিপিসি। ওই সব এলাকায় বহু চাষির বাড়িতেই বস্তা বস্তা ধান ডাঁই হয়ে রয়েছে। সরকার কবে সহায়ক মূল্যে ধান কিনবে, সেই আশায় হাপিত্যেশ করে বসে আছেন চাষিরা। শ্রীখণ্ডের চাষি রঘুনাথ মণ্ডল, সনৎ সাহা, সৃষ্টিধর সাহারা বলেন, “এই অবস্থায় জমি ধরে রাখার মানে হয় না। ন্যায্য মূল্য পেলে এনটিপিসি-কে জমি দিয়ে দেব।” দেবকুণ্ডু গ্রামের হৃদয় ঘোষ, পরেশনাথ মণ্ডলদের কথায়, “আগেও জমি দিয়েছি। এ বারও দেব। তবে একই জায়গায় যেন দু’রকম দর না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।”
রাজনৈতিক দলগুলি এনটিপিসি-র উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে, অন্তত প্রকাশ্যে। কাটোয়ার কংগ্রেস বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, কেতুগ্রামের (প্রকল্পের বেশির ভাগটাই এই এলাকায় পড়ছে) তৃণমূল বিধায়ক শেখ সাহানেওয়াজ, সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অচিন্ত্য মল্লিকেরাও এক বাক্যে জানান, চাষিরা জমি দিতে রাজি। তবে অচিন্ত্যবাবুর মতে, “চাষিরা যাতে আগের চেয়ে বেশি দাম পান, তা দেখা উচিত।” ইতিমধ্যেই জমি নিয়ে রাজনীতির বিপুল খেসারত দিয়েছে রাজ্য। এ ক্ষেত্রেও যে তা হবে না ও এনটিপিসি-র দেওয়া দরে সব চাষি এক বাক্যে সম্মত হবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই। ফলে, মমতার জমিনীতি মেনে নিয়ে শিল্পায়নের এই ‘পরীক্ষা’ কতটা সফল হয়, সেটাই দেখার। |