|
|
|
|
ইটপাটকেল-কটূক্তি, সত্তরের আবেগ ময়দানে |
চার গোল খেয়ে ইস্টবেঙ্গল মারের ভয়ে মাঠেই বন্দি |
রতন চক্রবর্তী • কলকাতা |
পঁচাত্তরে ডার্বি ম্যাচে পাঁচ গোলে হারার পরে ইলিয়ট রোডের মোহনবাগান মেস ঘিরে ফেলেছিলেন কয়েক হাজার সমর্থক। গঙ্গায় ভাসমান একটি নৌকোয় রাত দু’টো পর্যন্ত লুকিয়ে বসে ছিলেন সুব্রত ভট্টাচার্য। পুলিশের গাড়িতে চড়ে মেসে ফিরেছিলেন পরের দিন ভোরে।
ঊনসত্তরে পোর্ট ট্রাস্টের সঙ্গে ড্র করেছিল ইস্টবেঙ্গল। তাঁবুর ছাদ ফুঁড়ে আসা ইট-পাটকেল থেকে বাঁচতে লোহার বালতির মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে টেবিলের নীচে আশ্রয় নিতে হয়েছিল সুভাষ ভৌমিককে। দু’দিন ফিরতেই পারেননি নিউ আলিপুরের বাড়িতে।
আটাত্তরে অখ্যাত উয়াড়ির কাছে হেরে পিটুনি খান ইস্টবেঙ্গলের
গোলরক্ষক ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়। লাথি-ঘুষি-থুতু, কিছুই বাদ যায়নি। রাত বারোটায় পুলিশের গাড়ি ভাস্করকে ক্লাব তাঁবু থেকে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল শিয়ালদহে। প্রাণভয়ে দুর্গানগরের বাড়িতে না ফিরে তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন এক বন্ধুর কাছে।
সত্তর-আশির দশকের সেই বাঁধভাঙা আবেগ মঙ্গলবার যেন ফিরে এল ইস্টবেঙ্গল মাঠে। |
|
ফুঁসছে গ্যালারি। খেলোয়াড়রা বেরোচ্ছেন পুলিশি
পাহারায়। মঙ্গলবার উৎপল সরকারের তোলা ছবি। |
সেই ঘেরাও, পুলিশের লাঠির গুঁতো, ঘোড়সওয়ার পুলিশের দৌড়োদৌড়ি, মাঠে দেদার ইট-পাটকেল-বোতল ছোড়া, ক্রুদ্ধ সদস্য-সমর্থকদের বিক্ষোভ ফিরিয়ে আনল সুব্রত-সুভাষ-ভাস্করদের বহু স্মৃতি। এরিয়ানের কাছে ১-৪ গোলে বিধ্বস্ত হওয়ার পর সমর্থকদের হাতে মার খাওয়ার ভয়ে এ দিন প্রায় পঁচিশ মিনিট মাঠের মধ্যেই আটকে থাকতে হল ট্রেভর মর্গ্যানের গোটা ইস্টবেঙ্গল দলকে। ময়দানে এমন নজির বিরল। তার পরে বিশাল পুলিশবাহিনী ব্যারিকেড গড়ে টোলগে-পেন-ওপারাদের তাঁবুতে ফেরালেও পরিস্থিতি সামলাতে মাঠের বাইরে ঘোড়সওয়ার পুলিশকে লাঠিচার্জ করতে হল। যুগ্ম কমিশনার জাভেদ শামিমের যদিও দাবি, “লাঠিচার্জ হয়নি।” সমর্থকদের হাত-পা-পিঠের লম্বা দাগ কিন্তু অন্য কথা বলছে।
ম্যাচ শেষ হওয়ার এক মিনিট আগেই তাঁবুর দিকে হাঁটা দিয়েছিলেন ব্রিটিশ কোচ। কিন্তু সমর্থকরা তাঁকে হেনস্থা করতে ছাড়েননি। মর্গ্যানকে লক্ষ করে ছোড়া হয় থুতু, ইট, জলের বোতল। তাঁর দলের ফুটবলাররাও বাদ যাননি। ইট-বোতল ছোড়া হয় তাঁদের দিকেও। এমনকী মুখে জল ভরে কুলকুচিও করে দেওয়া হয় খেলোয়াড়দের গায়ে। সঙ্গে অকথ্য গালাগালি। জার্সি টেনে ফেলে দেওয়ার চেষ্টাও করেন কিছু সমর্থক। ম্যাচ শেষে রিজার্ভ বেঞ্চে জল খেতেও ফিরতে পারেননি মেহতাব-ওপারারা। কারণ, রিজার্ভ বেঞ্চের পিছনের জালের উপরে উঠে থুতু আর জলের কুলকুচি ছড়াচ্ছিলেন সমর্থকরা। শনিবার ডার্বি ম্যাচে হারের পর গোলকিপার সন্দীপ নন্দীকে চড়-থাপ্পড় মারা হলেও এ দিন সে রকম কিছু ঘটেনি। তবে যে রাস্তা দিয়ে ফুটবলাররা ফেরেন, সেখানে শুয়ে পড়ে অবরোধ করেন হতাশ সমর্থকরা। চলে কান্নাকাটিও। এক দর্শককে দেখা যায় ব্লেড দিয়ে নিজের হাত ফালাফালা করে দিচ্ছেন। গভীর রাতেও দেখা গেল,শয়ে শয়ে সমর্থক জোট বেঁধে বসে রয়েছেন ময়দানের আনাচে-কানাচে। চলছে হা-হুতাশ, “কোন মুখে আজ পাড়ায় ফিরব!” আর যাঁরা ‘পাড়ায় ফিরেছেন’, ফেসবুক-টুইটারে উগরে দিয়েছেন লাগামছাড়া হতাশা।
পুলিশের আড়ালে মাঠ থেকে তাঁবুতে ফিরলেও ফুটবলাররা সেখানে আটকে থাকেন অনেক রাত পর্যন্ত। সবার শেষে যখন মেহতাব বেরোচ্ছেন, তাঁর গাড়ি ঘিরে ধরেন কয়েকশো সমর্থক। চলে অনর্গল গালাগালি। ক্লাব তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসেন কিছু কর্তা। তাঁদের সঙ্গেও সমর্থকদের বচসা শুরু হয়। বিশাল পুলিশবাহিনী ঘিরে রাখে তাঁবু। ঘটনাস্থলে পৌঁছন ডিসি (সাউথ) দেবেন্দ্রপ্রকাশ সিংহ। ইডেনের সামনে ইস্টবেঙ্গল মাঠে ঢোকার রাস্তায় চেক পোস্ট বসিয়ে দেয় পুলিশ। ময়দানের প্রায় সমস্ত ঘোড়সওয়ার পুলিশ চলে আসেন ঘটনাস্থলে। তাঁরাই ঘোড়া ছুটিয়ে, লাঠি চালিয়ে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করেন ক্ষুব্ধ জনতাকে। তাড়া খেয়ে দৌড়লেও পরে আবার ফিরে আসেন সমর্থকরা। রাত পর্যন্ত চলে কোচ-কর্মকর্তাদের মুণ্ডপাত। ক্লাব কর্তাদের বক্তব্য, চার গোল খাওয়ার পরে সমর্থকদের সংযমের বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। কিন্তু আসলে আগের বড় ম্যাচে নাস্তানাবুদ হওয়ারই প্রতিক্রিয়া এটা।
সত্তর-আশিতে হারের পর যেমন ফুটবলারদের বিরুদ্ধে ঘুষ খাওয়ার অভিযোগ উঠত, তা-ও ফিরেছে এ দিন। ৯ বছর বড় ক্লাবে খেলছেন মেহতাব হোসেন। কখনও এ রকম বিক্ষোভ দেখেননি। বিভ্রান্ত হয়ে বলছিলেন, “সিনিয়রদের মুখে শুনেছি, আগে এ সব হত। কিন্তু স্বচক্ষে এই প্রথম দেখলাম।” এ দিন তাঁর গাড়িতে চাপড় মেরে এক দল দর্শককে বলতে শোনা যায়, “টাকা খেয়েছিস! তোকে ছাড়ব না!” গত বারের সোনার বুট-জয়ী বলছিলেন, “আমার কমিটমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। এগারো জন তো খেলছে। আমাকেই কেন টার্গেট করা হচ্ছে!” লাল-হলুদের সঙ্গে দশ বছর জড়িয়ে অ্যালভিটো ডি’কুনহা। হাতজোড় করে বিক্ষোভ থামাতে গিয়ে তিনিও দিশাহারা। শুরুতে হাত-পা ছুড়ে ‘ভেরি ব্যাড, ভেরি ব্যাড’ বলে চিৎকার করলেও, পরে বলেন, “ওঁরা কষ্ট করে খেলা দেখতে আসেন। দুঃখ পাওয়া স্বাভাবিক। সারা বিশ্বেই এমন ক্ষোভ হয়।”
যা শুনে পি কে বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “মর্গ্যান সাহেব কিছুই দেখেননি। বাহাত্তরে ভ্রাতৃ সংঘের সঙ্গে ম্যাচ বিরতিতে ড্র চলছিল। তাতেই জালের ভিতর দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার কলার টেনে ছিঁড়ে নিয়েছিল। মাথায় চাঁটি মেরেছিল। থুতু খাওয়া তো বাঁধা ছিল।” সত্তর-আশির দশকের সেরা ক্লাব কোচের বহু স্মৃতি এখনও টাটকা। গড়গড় করে বলে যেতে পারেন মাঠে গণ্ডগোলের ইতিহাস। “আমার সময়ে হারতাম কম। ড্র হত বেশি। আর তাতেই যা গণ্ডগোল হত। মার খেতেও হত। ছেলেদের বলতাম টেবিল-চেয়ারের তলায় লুকিয়ে থাকতে। ছিয়াত্তরে এক বার আমার স্ত্রীকেও হেনস্থা করেছিল এক দল দর্শক। ঘোড়সওয়ার পুলিশ বাঁচায়। পুলিশ পাহারায় বাড়ি ফেরা ছিল রোজের ঘটনা।”
তবুও মর্গ্যানের মতোই পিকে-ও মনে করেন, এ রকম হওয়াটা উচিত নয়। এ ধরনের ঘটনায় ফুটবলারদের মনোবল ভেঙে যায়।
বাঁধভাঙা এই আবেগকে সম্বল করে সত্তর-আশির দশকের সেই আকর্ষণও কি ফিরছে কলকাতা ফুটবলে? সুব্রত ভট্টাচার্যের মতো অনেকেই এ কথা বিশ্বাস করেন। ক্রিকেটে কলকাতা যে আগের মতো মজছে না, সাম্প্রতিক টেস্ট ও এক দিনের ম্যাচে ইডেনের চেহারাতেই তা স্পষ্ট। সুব্রতর মতে, সত্তরের মতো বড় দল-ছোট দলে ফারাকটাও এখন অনেকটা কমে গিয়েছে। রাত জেগে এখন ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড বা বার্সেলোনার খেলা দেখছে কলকাতার নতুন প্রজন্ম। বিকেলে তারাই আবার ভিড় জমাচ্ছে ময়দানে। সুব্রত বলছেন, এই কারণেই কলকাতা ফুটবলের সেই হারানো উন্মাদনা ফিরছে। মঙ্গলবারের ঘটনাও তারই প্রমাণ। |
|
|
|
|
|