মঙ্গলবার ভোরেই কথাটা ছড়িয়ে পড়েছিল মুখে মুখে। কালো মাথা গিজগিজ করছিল বালি-বেলুড় বরাবর গঙ্গার পশ্চিম তীরে। কারও হাতে বালতি, কারও হাতে হাঁড়ি, কেউ বা নিয়ে এসেছেন বাজারের ব্যাগ। কাদার মধ্যে ছুটছেন কেউ কেউ। রব উঠেছে, ‘ওই যে, ওই যে।’
কীসের জন্য সাতসকালে এত মানুষের জমায়েত? জানা গেল, ভাটায় জলে টান পড়তেই শ’য়ে শ’য়ে কচ্ছপ উঠে এসেছে কাদায়। সেই কচ্ছপ ধরতেই এমন মাতামাতি। এক-একটা লম্বায় ৭০০ মিলিমিটারের মতো। খোলার রং কালচে সবুজ। বৈজ্ঞানিক নাম ‘ইন্ডিয়ান সফ্ট শিল্ড টার্টল’। গঙ্গা, মহানদী, ব্রহ্মপুত্র ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে মেলে এই কচ্ছপ।
কচ্ছপের খবর যখন বন দফতর এবং পুলিশের কানে পৌঁছল, ততক্ষণে ব্যাগে, বালতিতে, প্যান্টের পকেটে বা হাঁড়িতে পাচার হয়ে গিয়েছে অধিকাংশই। চড়া দামে বিক্রি হয়েছে বাজারে। পুলিশ আর বন দফতরের অফিসারেরা এসে পৌঁছতে জানা গেল ‘কচ্ছপ রহস্য’। |
গৃহস্থের বাড়িতে সেই কচ্ছপ। নিজস্ব চিত্র |
কী সেই রহস্য? গত রবিবার লিলুয়ার ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে একটি ছোট ট্রাক ভর্তি ৬৪৬টি কচ্ছপ উদ্ধার করেছিল হাওড়া পুলিশের গোয়েন্দা দফতর। কচ্ছপগুলি তুলে দেওয়া হয়েছিল হাওড়া বন দফতরের হাতে। আদালতের নির্দেশে সেই কচ্ছপগুলি সোমবার রাতেই বালির পঞ্চাননতলা ঘাট থেকে মাঝ গঙ্গায় ছেড়ে দেন বনকর্মীরা। কিন্তু তারা যে রাত পোহাতেই পাড়ে উঠে আসবে, তা বুঝতে পারেননি তাঁরা।
সকাল সাড়ে সাতটা থেকে এমন কচ্ছপ-কাণ্ড চললেও বনকর্মীদের পাওয়া গেল সকাল ন’টায়। আর সারা দিন দেখাই গেল না পুলিশকে, যারা কচ্ছপগুলিকে উদ্ধার করেছিল। হাওড়ার বনাধিকারিক গৌতম চক্রবর্তী বলেন, “সকালে খবর পাওয়ার পরে আমাদের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে অধিকাংশ কচ্ছপই উদ্ধার করে ফের মাঝ গঙ্গায় ছেড়ে দিয়ে এসেছেন। তবে কয়েকটি কচ্ছপ স্থানীয় লোকজন নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু কচ্ছপ বিক্রি হয়েছে বলে শুনিনি।” কিন্তু পুলিশ? হাওড়া সিটি পুলিশের অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার (উত্তর) রশিদ মুনির খান বলেন, “গঙ্গার পাড় থেকে কচ্ছপ ধরা পুলিশের কাজ নয়। আমরা খবর পেয়েই বন দফতরকে জানিয়েছি।’’
কয়েকটি কচ্ছপ স্থানীয়েরা নিয়ে যান বলে বন দফতরের আধিকারিক দায় সারলেও পঞ্চাননতলা ঘাট ও পাঠকঘাট সংলগ্ন বস্তিগুলিতে গিয়ে দেখা গেল, কারও বাড়ির অ্যাকোয়ারিয়ামে, কারও বাড়ির বালতিতে, কারও গামলায় কচ্ছপ রয়েছে। কেউ কেটেকুটে মশলা মাখিয়ে কচ্ছপের মাংস নিয়ে গিয়েছেন রান্নাঘরে। যাঁরা তাড়াতাড়ি গিয়েছেন, তাঁরা পেয়েছেন বেশ কয়েকটি কচ্ছপ। যেমন মিলন সিংহ। তাঁর দাবি, “সকালে ছ’টা ধরেছিলাম। এক জন চারটে কেড়ে নিল। একটা ৩৫০ টাকায় বিক্রি করেছি। আর একটা বাড়িতে রেখে দিয়েছি।” এক বৃদ্ধের দাবি, “পেয়েছিলাম পাঁচ-ছটা। কেড়ে নিয়ে গেল সব। কোঁচড়ে একটা এনেছি। ছেলে ৪০০ টাকায় বিক্রি করেছে।”
রাস্তার মোড়ে মোড়ে আলোচনা কে ক’টা কচ্ছপ ধরেছে। কেউ আটটা তো, কেউ দশটা। কিন্তু যখন জানা গেল, এগুলি পুলিশের বাজেয়াপ্ত করা কচ্ছপ, তখন মোড়ের জটলা ফাঁকা। কেউই স্বীকার করতে চান না যে, তিনি কচ্ছপ পেয়েছেন। বন দফতরের কর্তারা ততক্ষণে ঘোষণা করেছেন, কচ্ছপ অতি বিরল প্রজাতির প্রাণি। বাড়িতে রাখলে জেল হতে পারে।
সল্টলেকে বনবিতানে বড় পুকুর রয়েছে। সাধারণত বাজেয়াপ্ত হওয়া কচ্ছপ বন দফতর সেখানেই ছাড়ে। কিংবা ছেড়ে দিয়ে আসে কোনও সংরক্ষিত এলাকায়। গঙ্গার পাড় যখন এ সব এলাকায় বাঁধানো এবং দূষণ মাত্রাছাড়া, তখন কেন তাড়াহুড়ো করে সেখানে ছাড়া হল কচ্ছপ?
হাওড়ার বনাধিকারিক বলেন, “এত কচ্ছপ ছাড়ার মতো খালবিল হাওড়ায় নেই বা পরিকাঠামো জেলা বন দফতরের নেই। গঙ্গাই কচ্ছপ ছাড়ার ভাল জায়গা বলে ভেবেছিলাম।” |