রাজ্যে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ‘দক্ষতা’র করুণ চিত্রটি ফুটে উঠল ‘বেঙ্গল লিডস’-এর দ্বিতীয় দিনেই। জেনারেল মোটরসের অন্যতম শীর্ষ কর্তা ডঃ ক্রিস্টোফার বোরোনি বার্ড প্রায় ফাঁকা হলঘরে অন্তত চল্লিশ মিনিট বসে রইলেন শ্রোতাদের প্রতীক্ষায়। পরে পরিস্থিতি সামলাতে আলোচনার মাঝে হাজির হতে হল স্বয়ং শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। এখানেই শেষ নয়। আলোচনা শেষে বার্ডকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য পুষ্পস্তবকের ব্যবস্থা করতে মন্ত্রীকেই উদ্যোগী হতে হল। সেই উদ্যোগও অবশ্য ফলপ্রসূ হয়নি।
মঙ্গলবার সকাল থেকে মিলনমেলায় ‘বেঙ্গল-লিডস’-এ শিল্পমন্ত্রী হাজির ছিলেন। সেখানেই দফতরের কাজকর্ম সারার পাশাপাশি শিল্পমহলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাদা ভাবে বৈঠক করেন তিনি। পার্থবাবু জানান, শিল্প-কর্তাদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা ও সম্মেলনে আগত প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করার জন্য তাঁকে মিলনমেলাতেই থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শিল্পমহলও এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। |
ক্রিস্টোফার বোরোনি বার্ডের সঙ্গে বৈঠক শেষে শিল্পমন্ত্রীর উপহার। এর পরেই আলোচনাচক্রে
গিয়ে বার্ড দেখেন শ্রোতা বলতে গেলে কেউ নেই। জোটেনি পুষ্পস্তবকও। নিজস্ব চিত্র |
দুপুর পর্যন্ত শিল্পমন্ত্রীর বৈঠকপর্ব বেশ ভাল চললেও তাল কেটে যায় বার্ডের আলোচনাচক্রের সময়ে। গাড়ি-শিল্পে লগ্নি নিয়ে রাজ্যের আগ্রহের কথা বোঝাতে এই শিল্প সম্মেলনের আগে বহু বার বার্ডের উপস্থিতির কথা তুলে ধরেছিল শিল্প দফতর ও রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগম। আধুনিক প্রযুক্তির গাড়ি নিয়ে বার্ড ও তাঁর সংস্থা গবেষণা চালাচ্ছে। ভারতে তার উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরির বিষয়ে আলোচনা করতেই কলকাতা ও বেঙ্গালুরু সফরে এসেছেন বার্ড। ভবিষ্যতে গাড়ি-শিল্পের আধুনিক প্রযুক্তি ও জেনারেল মোটরসের বৈদুতিন গাড়ি ‘ইএন-ভি’ নিয়ে এ দিন বেলা দু’টোয় তাঁর একটি একক উপস্থাপনা ও আলোচনাচক্র ছিল মিলনমেলার অডিটোরিয়ামে। বেলা দেড়টা পর্যন্ত শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে তিনি উপস্থাপনার প্রস্তুতি নিতে চলে যান। এমনকী, এর মাঝে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখিও হতে চাননি জেনারেল মোটরস-কর্তা।
কিন্তু নির্ধারিত সময়ে প্রেক্ষাগৃহে ঢুকে তিনি কার্যত থ হয়ে যান। দেখা যায়, শিল্পোন্নয়ন নিগমের হাতে গোনা কয়েক জন আধিকারিক ও গুটিকয়েক সাধারণ দর্শক ছাড়া কেউ সেখানে নেই! বার্ডের সঙ্গে ছিলেন উপদেষ্টা সংস্থা ‘ফ্রস্ট অ্যান্ড সুলিভান’-এর কর্তা সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় (মূলত যাঁর উদ্যোগে বার্ডের এ শহরে আগমন)। শ্রোতাদের জন্য তাঁরা অপেক্ষা করতে থাকেন। ও দিকে তখন আর এক হলে শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসে পড়েছে সিঙ্গাপুরের শিল্প-প্রতিনিধিদল।
অপেক্ষার কাঁটা প্রায় আধ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরে অধৈর্য হয়ে পড়েন সুব্রতবাবুরা। হতাশ সুরে সুব্রতবাবু বলেন, “কাল দিদি বলে গেলেন এ রাজ্যে আসতে। কিন্তু দেখছেন তো, ঘর প্রায় পুরোটাই খালি! মঞ্চে উঠে উনি কাকে কী শোনাবেন? আমি বাঙালি বলেই এখানে ওঁদের প্রথম নিয়ে এসেছিলাম।” বার্ড অবশ্য সৌজন্যবোধ দেখিয়ে স্মিত হেসে বলেন, “সকলেই শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে আসছেন। তাই ওঁরা হয়তো ব্যস্ত।” এর পরেই সংবাদমাধ্যমের হাত এড়াতে তড়িঘড়ি ওঁদের ডেকে নিয়ে আলোচনাচক্র শুরু করে দেন আয়োজকেরা। ঘড়িতে তখন প্রায় পৌনে তিনটে।
ইতিমধ্যে সিঙ্গাপুরের শিল্প-প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক সেরে অডিটোরিয়ামে গিয়ে বার্ডের উপস্থাপনার বাকিটা শোনেন শিল্পমন্ত্রী। অনুষ্ঠানের শেষের দিকে তিনি পুস্পস্তবকের জন্য উদ্যোগী হলেও দেখা যায়, নিগমের আধিকারিকেরা একেবারেই প্রস্তুত নন। ফলে জেনারেল মোটরস-কর্তার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য ফুলের তোড়ার বন্দোবস্ত আর করাই যায়নি!
এ হেন ‘অব্যবস্থা’ কেন?
শিল্পমহলের একাংশের মতে, বণিকসভাগুলোকে আলোচনায় সামিল হতে বলার ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাবের জেরেই হাজিরার সমস্যা দেখা দিয়েছে। যদিও এই অভিযোগ নস্যাৎ করে শিল্পমন্ত্রী দাবি করেন, সেমিনারে শ্রোতা যথেষ্টই ছিলেন। আলোচনাও ভাল হয়েছে, এবং এ নিয়ে বার্ড তাঁদের কিছু বলেননি। সংবাদ মাধ্যম অযথা জলঘোলা করছে বলেও পার্থবাবুর অভিযোগ।
শিল্পমন্ত্রী পরে মহাকরণের দিকে রওনা হয়ে গেলেও ফের মেলায় ফিরে আসেন। সরকারি সূত্রের খবর: মহাকরণে মন্ত্রিসভার বৈঠক শুরু হয়ে যাওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে শিল্পমেলাতেই থাকতে বলেন। সম্মেলনস্থলে ফিরে শিল্পমন্ত্রী ছোট ও মাঝারি শিল্প নিয়ে পরের আলোচনাচক্রে আগাগোড়া উপস্থিত থাকেন। তখন অবশ্য হল বেশ কিছুটা ভতির্র্। পরে পর্যটনশিল্পের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সেখানেই আলাদা বৈঠক করেন পার্থবাবু।
এর আগে এসপিএস গোষ্ঠীর কর্তা বিপিন ভোরার সঙ্গে মেলা অফিসেই বৈঠক করে তাঁদের ইস্পাত-প্রকল্পের জমির সমস্যার সমাধান করেন শিল্পমন্ত্রী। পরে বিপিনবাবু জানান, বাঁকুড়ায় তাঁদের প্রস্তাবিত প্রকল্পের জমি নিয়ে কিছু সমস্যা ছিল। তা কেটে গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী সময় দিলেই তাঁর উপস্থিতিতে শিলান্যাস হবে। ইস্পাত-হোটেল-উপনগরীতে তাঁরা পশ্চিমবঙ্গে সব মিলিয়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা লগ্নি করবেন। ফ্রস্ট অ্যান্ড সুলিভানের সুব্রতবাবুও জানিয়ে গিয়েছেন, জেনারেল মোটরসের বৈদ্যুতিন গাড়িটি চালানোর উপযুক্ত পরিকাঠামো নির্মাণের ব্যাপারে শিগগিরই তাঁরা রাজ্যকে প্রস্তাব দেবেন।
এ দিকে সিঙ্গাপুর ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’র চেয়ারম্যান নারায়ণমোহন শিল্পমন্ত্রীকে প্রতিনিধিদল নিয়ে সে দেশে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, তাঁরা এ রাজ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে লগ্নির সুযোগ খতিয়ে দেখতে আগ্রহী। আর যে ভাবে অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে এই শিল্প সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে, তারও প্রশংসা করেন তিনি। |