কাজই হয় না, ‘সরকারি’ ওষুধে ভরসা হারিয়ে রোগীরা দোকানে
ছর দু’য়েক আগের কথা। রুটিন অভিযানে মালদহের জেলা মেডিক্যাল স্টোর্স থেকে রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখার একটি ওষুধের নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন ড্রাগ কন্ট্রোল ইন্সপেক্টরেরা। রাজ্য ড্রাগ ল্যাবরেটরি পরীক্ষা করে রিপোর্ট দেয়, তার মান অত্যন্ত খারাপ। অবিলম্বে ওষুধটি তুলে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
কিন্তু তত দিনে জেলার সব সরকারি হাসপাতালে সেটি সরবরাহ করা হয়ে গিয়েছে। বহু রোগী তা খেয়েও ফেলেছেন। একই ভাবে বছরখানেক আগে যখন ধরা পড়ল যে, কোচবিহার জেলা মেডিক্যাল স্টোর্সে রাখা অ্যালার্জি নিরাময় ও ভিটামিন বি-কমপ্লেক্সের দু’টো ওষুধের মান ‘অতি নিম্ন’, তখনও দেরি হয়ে গিয়েছে বিস্তর।
এমন উদাহরণ প্রচুর। বস্তুত সরকারি হাসপাতাল থেকে বিনা পয়সায় ওষুধ মিললেও বহু রোগী তা নিতে চান না। ওঁদের অভিযোগ, তাতে কোনও কাজই হয় না! এমনকী চিকিৎসকদের অনেকেরও স্পষ্ট স্বীকারোক্তি, “হাসপাতালে সরবরাহ করা ওষুধের মান এত খারাপ যে, তাতে রোগ সারে না।” অগত্যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাইরের দোকান থেকে ওষুধ কিনে আনা ছাড়া রোগীর পরিজনের উপায় থাকে না।


ম্যাজিক মূল্য
ওষুধ বাজারে দাম* সরকার কেনে
অ্যান্টাসিড
(১টি ট্যাবলেট)
১ টাকা ৮ পয়সায়
প্যারাসিটামল
(১০টি ট্যাবলেট)
১০ টাকা ১.৯৯ টাকায়
সেফোটক্সিম ৫০০
(২ মিলি অ্যাম্পুল)
৮০ টাকা ৮.৩৯ টাকায়
অ্যাজিথ্রোমাইসিন ৫০০
(১টি ট্যাবলেট)
১৬ টাকা ৬.৪৯ টাকায়
নরফ্লক্সাসিন ৪০০
(১০টি ট্যাবলেট)
৪৫ টাকা ৬.৩৩ টাকায়
স্যালাইন সেট ৭০ টাকা ৩.৫০ টাকায়
* গড়পড়তা ন্যূনতম দর
কিন্তু ‘সরকারি’ ওষুধ খেয়ে যাঁদের রোগ সারছে না, তাঁরা তো প্রমাণ করে দিতে পারেন, ওই ওষুধের মান কত খারাপ?
ঘটনা হল, সরকারি নিয়মেই সে রাস্তা কার্যত বন্ধ করে রাখা হয়েছে। কারণ ‘নিয়ম’ অনুযায়ী, রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলের কনভেন্ট রোডের ল্যাবরেটরিতে ওষুধ পরীক্ষা করাতে হলে আগে তা ‘কিনতে’ হবে। সেই ‘কেনা’ ওষুধের রসিদ বা ক্যাশমেমো দেখিয়ে তবেই মান পরীক্ষার আবেদন করা যাবে। অথচ ‘সরকারি’ ওষুধ কেনাটাই বেআইনি। কোনও দোকান তা বিক্রি করতে পারে না। প্যাকিংয়ের উপরেই লেখা থাকে ‘নট ফর সেল।’
অতএব, সাধারণ রোগীদের কেউ চাইলেও হাসপাতাল থেকে দেওয়া ওষুধের মান যাচাই করতে পারবেন না। আনন্দবাজারের তরফে রাজ্যের একাধিক সরকারি হাসপাতাল থেকে কিছু ওষুধের নমুনা নিয়ে পরীক্ষার জন্য রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কন্ট্রোলের অধিকর্তা চিন্তামণি ঘোষ একটি আবেদনপত্র দেখিয়ে বলেন, “ওষুধ কেনার তারিখ আর রসিদ নম্বর দিয়ে ফর্ম ভরে জমা দিতে হবে। তার পরে পরীক্ষা।”
কিন্তু সরকারি হাসপাতালে দেওয়া ওষুধ তো কেনা যায় না! তা হলে রসিদের প্রশ্ন কেন?
অধিকর্তার উত্তর, “সেই ফাঁক তো থাকছেই। তবে এটাই নিয়ম।” এবং এই বিচিত্র ‘নিয়মের’ প্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠছে, সন্দেহ হলে সাধারণ মানুষ তা হলে হাসপাতালের ওষুধ সরকারি ল্যাবে পরীক্ষা করাবেন কী করে? যাতে করাতে না-পারেন, সে জন্যই কি এই নিয়ম?
সে প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। কিন্তু সরকারি ওষুধের মানই বা এত খারাপ কেন?
চিকিৎসক মহলের একাংশের ব্যাখ্যা, ‘ন্যূনতম’ দামে ওষুধ কেনার তাগিদেই এমন দুরবস্থা। প্রস্তুতকারীরা সরকারি বরাত পাওয়ার লোভে মানের সঙ্গে আপস করে বলে ওঁদের অভিযোগ। বর্ধমানের এক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তারের কথায়, “১৬ টাকার ওষুধ সাড়ে ছ’টাকায় কেনা হচ্ছে! কাজ হবে কী করে?” কলকাতা মেডিক্যালের এক প্রবীণ ডাক্তারের মন্তব্য, “জানি, কাজ হয় না। বাধ্য হয়ে রোগীদের বলতে হচ্ছে দোকান থেকে ওষুধ কিনে খেতে।”
মান যথাযথ নয় জেনেও এ ভাবে ওষুধ কিনছে কেন সরকার? স্বাস্থ্য-কর্তারা জানাচ্ছেন, তাঁরা নিরুপায়। কারণ অর্থ দফতরের নির্দেশিকা অনুযায়ী, টেন্ডারে ওষুধ বা চিকিৎসাসামগ্রীর সবচেয়ে কম দর দেবে যে সংস্থা, স্বাস্থ্য দফতর তাদের থেকে জিনিস কিনতে বাধ্য। কিন্তু এত কম দামে মাল দিতে গেলে মান খারাপ হওয়াটা স্বাভাবিক নয় কি?
প্রস্তুতকারীরা অবশ্য তা মানতে নারাজ। ‘স্মল স্কেল ড্রাগ ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাকশন কমিটি’র রাজ্য সম্পাদক মিহির সরকারের দাবি, “হোলসেলার-রিটেলারের কমিশন দিতে হয় না বলে আমরা হাসপাতালে কম দামে ওষুধ দিতে পারি। মানের সঙ্গে আপসের প্রশ্ন নেই।”
যদিও স্বাস্থ্য-কর্তাদের একাংশের মতে, পুরোটাই আসলে বরাত আদায়ের খেলা। ওঁরা বলছেন, “টেন্ডারে যথাসম্ভব দাম কমিয়ে অর্ডার পাওয়া হয়ে গেল। অথচ সেই ওষুধে রোগ সারল কি না, কেউ খোঁজ রাখল না!” দফতরের ‘প্রোকিওরমেন্ট’ বিভাগের এক কর্তার আক্ষেপ, “মানের কথা মাথায় রেখে এক বার অন্য কোম্পানির কাছ থেকে জিনিস কেনার চেষ্টা হয়েছিল। যারা সবচেয়ে কম দাম দিয়েছিল, তারা তখন মামলা ঠুকে দিল। কোর্টের নির্দেশে টেন্ডার-প্রক্রিয়াই স্থগিত হয়ে গেল। তাই এখন আমরা আর ঝুঁকি নিই না।” আবার এমন অভিযোগও রয়েছে যে, অনেক ক্ষেত্রে নিম্নমানের ওষুধ বা চিকিৎসাসামগ্রী কেনার পিছনে কিছু চিকিৎসকের সঙ্গে বিভিন্ন সংস্থার ‘ব্যক্তিগত সম্পর্ক’ বড় ভূমিকা নেয়। যে অভিযোগ প্রমাণ করা কার্যত অসম্ভব বলে স্বাস্থ্য-কর্তারাই মেনে নিচ্ছেন।
অগত্যা এ ভাবেই চলছে। রোগীদের বিনামূল্যে দেওয়ার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকায় সরকার ওষুধ কিনছে। কিন্তু সে ওষুধে ভরসা রাখতে না-পেরে রোগীকে ছুটতে হচ্ছে বাইরের দোকানে। আর্থিক সঙ্কটকালে এমন ঘটনাকে ‘নজরদারির অভাবজনিত অপচয়’ বলেও অভিহিত করেছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য প্রশাসনের অনেকে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.