চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...
প্রকৃতির প্রতি নিবিড় ভালবাসাই তাঁর প্রেরণা
ধুনিক ভারতীয় চিত্রকলার ধারায় নন্দলাল বসুর অবস্থান কোথায় এক কথায় এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। বিংশ শতকের গোড়ায় স্বদেশচেতনা আশ্রিত আধুনিকতার যে ধারা জেগে উঠেছিল, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার প্রথম পথিকৃৎ। তাঁর পর এই শিল্পনন্দন যাঁদের মধ্যে দিয়ে বিশ্বব্যাপ্ত হয়, নন্দলাল বসু তাঁদের মধ্যে প্রধান। অবনীন্দ্রনাথের ছাত্র হিসেবে এবং রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যচেতনা ও বিশ্বদর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে নন্দলাল প্রায় সারা জীবন শান্তিনিকেতনে বসে একাগ্র নিষ্ঠায় কাজ করেছেন। ঔপনিবেশিকতা বিরোধী এক প্রতিবাদী চেতনা ছিল তাঁর সমগ্র সৃষ্টিপ্রবাহের প্রধান চালিকাশক্তি। এই আদর্শের ভিত্তি থেকেই তিনি ঐতিহ্যগত জাতীয়তাবাদী রূপচেতনার এক বিশেষ আদল তৈরি করেছেন। পাশ্চাত্য আধুনিকতার কিছু সারাৎসারও খুব সূক্ষ্মভাবে অনুপ্রবেশ করেছে তাঁর সৃষ্ট রূপের মধ্যে। সারা জীবন তাঁর প্রধান প্রেরণা ছিল জীবন ও প্রকৃতির প্রতি নিবিড় ভালবাসা।
সেই একাত্ম প্রেমের স্বরূপ কেমন, তা সবচেয়ে বেশি প্রতিভাত হয় তাঁর ছোট ছোট একান্ত ব্যক্তিগত অঙ্কনের মধ্যে। প্রায় সারা জীবন, বিশেষত জীবনের শেষ পর্বে তিনি চিঠি লিখতে খুব ভালবাসতেন। তাঁর কাছের মানুষ ও প্রিয় ছাত্রদের এরকম অজস্র পোস্টকার্ড তিনি পাঠিয়েছেন। সেই পোস্টকার্ডের এক দিকে তিনি ছবি এঁকে পাঠাতেন। এই চিঠিগুলির বেশির ভাগই রয়ে গেছে নানা ব্যক্তিগত সংগ্রহে, তাঁর অনেক প্রিয় মানুষের কাছে। বাইরের মানুষের কারোওরই তা দেখার কোনও সুযোগ ছিল না।
শিল্পী: নন্দলাল বসু
সেই সুযোগ এল এবার আমাদের সামনে। আকার প্রকার গ্যালারির উদ্যোগে সেখানে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল সেরকম ৭০এরও বেশি ছোট ছবি নিয়ে প্রদর্শনী। প্রদর্শনীটি পরিকল্পনা বা কিউরেট করেছেন দেবদত্ত গুপ্ত। নন্দলালের আত্মীয়-স্বজন ও তাঁদের উত্তরাধিকারীর কাছ থেকে তিনি সংগ্রহ করেছেন ছবিগুলি।
ছবিগুলিকে ছ’টি পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে : পোস্টকার্ড ও কাগজের উপর ড্রয়িং, কালি-তুলির কাজ, অন্য মাধ্যম জলরং বা মিশ্রমাধ্যম, ছাপচিত্র, ‘টাক ডুমা ডুম ডুম’এর চিত্রায়ণ ও কোলাজ বা কাগজ-সাঁটা ছবি।
ধ্রুপদী ছন্দ ও লৌকিক সারল্য দু’রকম রেখাতেই তিনি কাজ করেছেন প্রয়োজন মতো। ধ্রুপদী ছন্দিত রেখার অসামান্য দৃষ্টান্ত বীণাবাদিনী সরস্বতীর একটি রূপায়ণ। আবার একটু আলুলায়িত ছাড়া ছাড়া রেখার সমাহারে এঁকেছেন ‘জয়নগরের মোয়া, পাটালি নলেন গুড়’ বিক্রেতার ছবি। একই ভঙ্গিতে দেখি বাঁশি বাজিয়ে যাওয়া সাঁওতাল দম্পতির ছবি। প্রথম পর্যায়ের ড্রয়িং-এর মধ্যে বিশেষ ভাবে মনোগ্রাহী আরশোলা, বাচ্চা নিয়ে মুরগির শস্যদানা খুঁটে খাওয়ার ছবি বা চিংড়ি, ন্যাদস, মৌরলা, ভ্যাঁদা ইত্যাদি মাছের অনুপুঙ্খ রূপায়ণ।
কালি-তুলির ছবিতে অনেক সময়েই এসেছে চিন বা জাপানের উত্তরাধিকার। একটি ঘাসের পাতার উপর হেঁটে যাচ্ছে একটি আরশোলা যার সরল রূপায়ণ মুগ্ধ করে। নিসর্গের ছবিগুলিতে চৈনিক রীতি নজর কাড়ে। অন্য মাধ্যম, বিশেষত জলরঙের ছবিগুলির ছন্দিত বিন্যাস অতুলনীয়। ২৪.১০.৪৮ তারিখে এঁকেছেন একটি শিশুর কাঁকড়া ধরার দৃশ্য। ১১.১১.৪৭ তারিখে আঁকা জঙ্গম এক ঝাঁক মাছের দৃশ্য। ছাপচিত্রে গাঁধীজির লাঠি হাতে হেঁটে যাওয়ার রৈখিক রূপায়ণটি শিল্পীর স্বদেশপ্রেমের এক অসামান্য দলিল। নিসর্গের একটি লিনোকাটে ‘সহজ পাঠ’এর সচিত্রকরণের ছবির স্বাদ পাওয়া যায়।
জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর লেখা ছোটদের গল্পগ্রন্থ ‘টাক ডুমা ডুম ডুম’ বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৫১ বঙ্গাব্দে। এই বইয়ের অলঙ্করণের জন্য নন্দলাল জলরঙে ছবি এঁকেছিলেন। তার দশটি ছবি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এই প্রদর্শনীতে। গ্রামীণ জীবনের সরল সুন্দর আলেখ্য প্রস্ফুটিত হয়েছে এক একটি চিত্রায়ণে। সাঁটা কাগজের ছবিতে পাওয়া যায় শিল্পীর সারল্যময় স্বতন্ত্র এক নন্দনবোধ। একটি কাগজকে হাত দিয়ে ছিঁড়ে বের করে এনেছেন দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ, জলে ভেসে চলা মাছ বা কোনও পশুর রূপ। তারপর পোস্টকার্ডের উপর সেঁটে দিয়েছেন তাকে। প্রকৃতি ও জীবনের প্রতি নিবিষ্ট ভালবাসা যাঁর তুলিতে সুরের মতো ঝরে পড়ে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.