৯৪টি প্রাণের বিনিময়েও ছবিটা পাল্টাল না।
ঢাকুরিয়ায় আমরি-র অ্যানেক্স বিল্ডিংয়ে যন্ত্রপাতি, দাহ্যে ঠাসা বেসমেন্টে বৃহস্পতিবার সকালে আরও এক বার বিস্ফোরণ ফের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যাঁদের নজরদারির কথা, তাঁরা সেই ‘উদাসীন’ই। হাসপাতালের বেসমেন্ট ভর্তি সরঞ্জামে বিপদের সম্ভাবনা জেনেবুঝেও চোখ বুজে ছিল দমকল তথা রাজ্যের প্রশাসন। তার জেরেই অ্যানেক্স বিল্ডিংয়ের অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ গিয়েছে এত জনের। ‘সিল’ করা হাসপাতালের বেসমেন্ট তবু সেই তিমিরেই। দমকলের দাবি, এ দিনের বিস্ফোরণের মূলেও হাসপাতালের ভিতরে পড়ে থাকা একটি যন্ত্র। তবে তার পরেও তৎপর হওয়া দূরে থাক, পুলিশ, দমকল, স্বাস্থ্য দফতর বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দায় চাপাচ্ছেন একে অন্যের উপরেই।
এ দিন সকালে ঢাকুরিয়ার আমরি-র অ্যানেক্স বিল্ডিংয়ে আচমকা বিকট শব্দ, ধোঁয়ায় ফের আতঙ্ক ছড়ায় চারপাশে। ৮ ডিসেম্বর রাতে হাসপাতালে আগুন লাগার পরে যাঁরা সবার আগে ওই তল্লাটে ছুটে গিয়েছিলেন, লাগোয়া পঞ্চাননতলা বস্তির সেই বাসিন্দারাই এ দিন খবর পেয়ে ফের ছুটে যান হাসপাতাল-চত্বরে। এ যাত্রা অবশ্য ‘সিল’ করা ভবনটির পাহারায় পুলিশকর্মীরা ছিলেন। তাঁরা দেরি না-করে দমকলে খবর দেন। |
দমকলের দাবি, হাসপাতালের ভিতরে পড়ে থাকা একটি এমআরআই যন্ত্র ফেটে হিলিয়াম গ্যাস বেরিয়ে যাওয়াতেই এমনটা ঘটেছে। আপাতত অবশ্য কোনও বিপদ ঘটেনি। তবে হাসপাতাল-চত্বরে কী কী যন্ত্র পড়ে রয়েছে, কোনটা থেকে কী ক্ষতি হতে পারে তার কোনও হিসেব তাঁদের কাছে নেই বলে প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগের কর্তারাই স্বীকার করছেন। দমকল, পুলিশ বা স্বাস্থ্য দফতর--- পড়ে-থাকা সরঞ্জামগুলি দেখভালের দায়িত্ব তাদের নয় বলে পরস্পরের দিকেই আঙুল তুলেছে প্রত্যেকেই। রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা আরও দাবি করেন, আপাতত বন্ধ থাকা হাসপাতাল চত্বরের অবস্থা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেই দেখতে হবে। আমরি-র সুপার সুমন ঘোষ অবশ্য বন্ধ থাকা ভবনে রাখা সরঞ্জামে বিপদের আশঙ্কা নেই বলে আশ্বাস দেন।
মাস চারেক আগে আমরি-তে পরিদর্শনের সময়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ‘ছাড়’ দিয়েছিল দমকল। বেসমেন্টে দাহ্য পদার্থ রাখা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও দমকলের পরামর্শে আমরি কর্তৃপক্ষ একটি হলফনামা দিয়ে ৯০ দিনের মধ্যে বেসমেন্ট ফাঁকা করার আশ্বাস দেন। আমরি-তে আগুন লাগার সময়ে সেই মেয়াদ পেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেয়নি দমকল। এ বারও বিস্ফোরণের পরেই জানা গিয়েছে, হাসপাতালের ওই ভবনে এমআরআই যন্ত্রটি পড়ে ছিল। দমকলের কর্তারা জানান, ওই যন্ত্র শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে রাখার কথা। তা না-রাখাতেই তরল হিলিয়াম গ্যাস হয়ে যন্ত্রের সেফ্টি-ভাল্ভ ফেটে বেরিয়েছে।
এমন সম্ভাবনার কথা প্রশাসনের কারও মাথায় আসেনি কেন? দমকলের অধিকর্তা গোপাল ভট্টাচার্য বলেন, “পুলিশ তদন্ত করছে। বাড়িটা ‘সিল’ করে দেওয়া হয়েছে। এখন বাড়ির ভিতরে কী পড়ে আছে, সেটা দমকলের দেখার কথা নয়।” কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) জাভেদ শামিমের কথায়, “পুলিশের পক্ষেও বোঝা সম্ভব নয়, কোন যন্ত্রে কী হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য দফতর কোনও পরামর্শ দিলে সেই মতো ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” আর স্বাস্থ্য দফতরের উপ-অধিকর্তা (প্রশাসন) হিমাদ্রি সান্যাল বলেন, “কোন যন্ত্রে কী ক্ষতি হতে পারে, সেটা তো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষেরই তদারক করার কথা।” তবে লালবাজারের এক কর্তা জানান, এখন আদালতের নির্দেশ ছাড়া হাসপাতাল থেকে কিছু সরানো মুশকিল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবশ্য দাবি, হিলিয়াম গ্যাস বেরোনোর ঘটনাতেও কোনও বড় বিপদের আশঙ্কা ছিল না। সিল-করা বাড়িটায় বিপজ্জনক কিছু আর পড়ে নেই।
আমরির ‘সিল’ করা বাড়িটিতে কী কী পড়ে আছে, তা নিশ্চিত ভাবে কেউ বলতে না-পারলেও পুলিশ কিন্তু মানছে, হাসপাতালে ছোটখাটো শব্দ থেকেই এখন এলাকায় আতঙ্ক ছড়াতে পারে। পঞ্চাননতলার বাসিন্দা সুকুমার নস্কর যেমন বলছিলেন, “সকালে হাসপাতালের পাশেই আমার পান-বিড়ির দোকানে বসেছিলাম। হঠাৎ দেখি হাসপাতালের দিক থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। দেখেই বুকটা আবার ছ্যাঁৎ করে উঠল। সঙ্গে-সঙ্গে গিয়ে শুনি, বাড়ির ভিতর থেকে বোমা ফাটার আওয়াজ পাওয়া গিয়েছে।”
এ দিন বিস্ফোরণের পরে দমকলের তিনটি ইঞ্জিন ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। অগ্নিকাণ্ডের পরেই হাসপাতালের বেসমেন্টে রাখা রেডিওথেরাপির যন্ত্র থেকে তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে কি না, তা দেখতে ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারের বিজ্ঞানীরাও আমরি-তে গিয়েছিলেন। ওই যন্ত্রটি তাঁরা তখনই হাসপাতাল থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। |