দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ‘বিপদ’ সম্পর্কে বারবার সতর্ক করেছিলেন। সেই ‘বিপদ’ ছিল দলের ভিতরেই! আর সতর্কিত হওয়ার পরেও ত্রুটিগুলি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ‘নিবিড় আন্তরিকতার অভাব’, দলীয় নেতা-কর্মীদের একাংশের ‘দাম্ভিক’ আচরণ ও ‘দুর্নীতি’ এবং ‘তরুণ প্রজন্ম’-এর বড় অংশের ভোট বিরোধীদের দিকে যাওয়ায় চলতি বিধানসভা নির্বাচনে নিজেদের শক্ত ঘাঁটিগুলিতেও দল মুখ থুবড়ে পড়েছে।
অন্য কোথাও নয়, দলের অষ্টাদশ পুরুলিয়া জেলা সম্মেলনের সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে এই স্বীকারোক্তি করেছে সিপিএম। প্রতিবেদনে দলের ‘আন্দোলন বিমুখতা’র কথা মেনে নেওয়ার পাশাপাশি রয়েছে দলীয় নেতা-কর্মীদের একটা বড় অংশের আচরণ নিয়ে সমালোচনা।
জেলার জঙ্গলমহল বা মাওবাদী সমস্যা ও হিংসা নিয়ে বিশেষ আলোচনাই করা হয়নি এই প্রতিবেদনে। অথচ গত দু-তিন বছরে জঙ্গলমহলে বিশেষ করে বলরামপুর-বাঘমুণ্ডি থানা এলাকায় মাওবাদীদের হাতে খুন হয়েছেন দলের বহু নেতা-কর্মী-সমর্থক। পাশাপাশি বলরামপুরের মতো ‘শক্ত ঘাঁটি’-তে এ বার বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের কাছে হারতে হয়েছে সিপিএমকে। জঙ্গলমহলের উল্লেখ বলতে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বলরামপুরে গত সম্মেলন থেকে আজ পর্যন্ত ১৮ জন নেতা-কর্মী-সমর্থক মাওবাদী-তৃণমূলীদের হাতে খুন হয়েছে’। জয়পুরে কংগ্রেস-তৃণমূলের মধ্যে ‘বিভেদ’ জারি রাখা গিয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই কেন্দ্রে অবশ্য জিতেছে ফরওয়ার্ড ব্লক। আর বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রীই ঘোষণা করেছেন মাওবাদীরা দেশের বিপদ’। |
প্রতিবেদন দেখে জঙ্গলমহলেরই এক সিপিএম নেতার ক্ষোভ, “এই ক’মাস ক্ষমতায় এসে তৃণমূল সরকার যে ভাবে মাওবাদীদের প্রতিরোধ করেছে, আমাদের সরকার এতটা সময় পেয়েও তা পারেনি। জঙ্গলমহলের ছোট-বড়-মাঝারি বিভিন্ন তৃণমূল নেতা এখন নিরাপত্তা পাচ্ছেন। আমাদের একের পর এক সহকর্মীকে মাওবাদীরা খুন করেছে। তাঁরা কিন্তু নিরাপত্তা পাননি। সম্মেলনে এই ক্ষোভের কথা অবশ্যই উঠবে।” প্রতিবেদনে মাওবাদীদের সম্পর্কে এত ‘কম কথা’ বরাদ্দ করার জন্যও ক্ষুব্ধ ও হতাশ জঙ্গলমহলের দলীয় নেতা-কর্মীদের একাংশ।
প্রতিবেদনের ‘রাজ্য পরিস্থিতি’র পর্যালোচনায় কবুল করা হয়েছে, ‘হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনও ঘটনা না ভেবে সামগ্রিক এই প্রেক্ষাপটের উপরে দাঁড়িয়ে বামফ্রন্ট সরকারের পতনের বিষয়টি বিবেচনা বিবেচনা করতে অনেকেই ভাবছিলেন, বামফ্রন্ট সরকার যেন চলতেই থাকবে। পার্টি বিপদ সম্পর্কে সচেতন করলেও এবং বারবার সতর্ক করলেও সর্বস্তরে সম-উপলব্ধির অভাব, উপলব্ধির মধ্যে এলেও ত্রুটিগুলি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য নিবিড় আন্তরিকতার অভাবের জন্য বিপদ এড়ানো যায়নি’।
পুরুলিয়ার মতো এক সময়ের ‘দুর্ভেদ্য ঘাঁটি’তে দলের ভরাডুবির কারণ খুঁজতে গিয়ে যে-সব কারণ প্রতিনিধিদের সামনে এনেছেন সিপিএম নেতৃত্ব, তার অন্যতম হল ‘রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্তরে কিছু ভুল সিদ্ধান্ত’। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এক দিকে শ্রেণি আন্দোলনের দুর্বলতা, অন্য দিকে পার্টি নেতৃত্ব-কর্মীদের একাংশের আচার-আচরণ, দাম্ভিকতা, ঔদ্ধত্য, অনৈতিকতা, স্বজনপোষণ প্রভৃতি ব্যধিগুলি মানুষকে আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছে’। একই সঙ্গে ‘বিধানসভা নির্বাচনের সমীক্ষা’য় স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে, ‘নতুন ভোটার বিশেষত তরুণ প্রজন্মের ভোটের একটা অংশ বিরোধীদের পক্ষে গিয়েছে। বিরোধীদের দ্বারা পরিচালিত পঞ্চায়েত এলাকায় সাধারণ মানুষদের নিয়ে দুর্নীতি, স্বজনপোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। কাজেই ওই সব অংশের মানুষের ব্যাপক অংশের সমর্থনও পাইনি’।
সিপিএম তথা বামফ্রন্ট শাসিত পঞ্চায়েত এলাকাগুলিতেও বিরোধীরা থাবা বসিয়েছে মেনে নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আমাদের পরিচালিত পঞ্চায়েত এলাকায় ওই সব বিষয়ে আন্দোলন করে আমাদের সমর্থকদের ছিনিয়ে নিয়েছে। কাজেই আমাদের ওই সব এলাকায় বিশেষত পাড়া, কাশীপুর, রঘুনাথপুর ১, মানবাজার ১, হুড়া, পুরুলিয়া ২ এলাকায় ব্যাপক ক্ষয় দেখা দিয়েছে’।
দলের আন্দোলন বিমুখতা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘গ্রামাঞ্চলে খেতমজুর ও বর্গাচাষি, গরিব চাষিদের মধ্যে অতীত দিনে খাদ্য, কাজ ও মজুরির জন্য যে আন্দোলনগুলি হত, এখন তা নেই বললেই চলে। ১০০ দিনের কাজ, বিপিএল তালিকাভুক্ত করা, ন্যায্য মূল্যে রেশন, কেরোসিন তেল পাওয়ার জন্য যে আন্দোলন অতীতে ছিল, বর্তমানে তা ছিল না। চাষের ব্যবস্থা, সেচের ব্যবস্থা করার জন্য আন্দোলনও এখন নেই বললেই চলে। লাক্ষা চাষি, রেশম চাষি, রিকশা-শ্রমিক, মুটিয়াদের যে সংগ্রাম-আন্দোলন এক সময় ছিল, এখন আর তা নেই’।
জেলা প্রায় প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্রে দলের প্রাপ্ত ভোটের হার ‘অস্বাভাবিক ভাবে’ কমে যাওয়ার পাশাপাশি নির্বাচনে এমন ফলাফল সম্পর্কে কোনও পূর্ব-অনুমানই যে সঠিক হয়নি, তা-ও স্বীকার করা হয়েছে প্রতিবেদনে। দলীয় মুখপত্রের প্রচার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পাওয়ার কথাও প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। একই সঙ্গে গত বছর জেলায় ব্যাপক খরার সময় কাজ দিতে না পারার বিষয়টি ভোটের ফলে প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করছেন জেলা সিপিএম নেতৃত্ব। সেই সূত্রেই প্রতিবেদনে দলের স্বীকারোক্তি, ‘বিগত দিনে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে খরা মোকাবিলায় এত উদাসীনতা কখনও লক্ষ করা যায়নি’। স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে দলে তরুণ সদস্য তুলে আনার প্রশ্নে জোনাল কমিটিগুলির ‘দুর্বলতার’ কথাও। |