বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিক্ততা ছিলই। এ বার সরাসরি কংগ্রেসকে রাজ্যের জোট সরকার থেকে বেরিয়ে আসার প্রস্তাব দিলেন বহরমপুরের কংগ্রেস সাংসদ তথা মুর্শিদাবাদের জেলা কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। পাশাপাশিই তিনি ঘোষণা করেছেন, মুর্শিদাবাদ জেলায় পঞ্চায়েত ভোটে ‘একাই’ লড়বে কংগ্রেস।
পঞ্চায়েত বা পুরভোটে অবশ্য অনেক সময়েই স্থানীয় স্তরে বাধ্যবাধকতার জন্য ‘অদ্ভুত’ সমস্ত রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি হয়। ফলে কংগ্রেস-তৃণমূল পঞ্চায়েত ভোটে একটি জেলায় জোট গড়ে না-লড়লেও আপাতদৃষ্টিতে তাতে ‘অস্বাভাবিকতা’ কিছু থাকবে না। কিন্তু রাজ্যে ৩৪ বছর পর বাম-শাসনের অবসান ঘটিয়েছে যে জোট, তারা যদি ক্ষমতায় আসার পর তাদের প্রথম বড় নির্বাচনেই ‘তিক্ততা’র বাড়াবাড়ি করে ফেলে, তা হলে তা অবশ্যই চর্চার বিষয় হবে।
তবে পঞ্চায়েত ভোট এখনও দূরে। অধীরবাবু বৃহস্পতিবার প্রকাশ্য জনসভায় যা বলেছেন, তার প্রভাব অনতিবিলম্বে জোটের উপর পড়ে কিনা, সেটাই দেখার। বহরমপুরের এফইউসি মাঠের সভা থেকে অধীর বলেন, “নতুন বোতলে পুরনো মদের মতো এই সরকার। বোতলের পরিবতর্ন হয়েছে। কিন্তু মদের পরিবর্তন হয়নি। এই সরকারে আমাদের না-থাকাই ভাল। আগামী পঞ্চায়েত ভোটে এ জেলায় কংগ্রেস একাই লড়বে।”
ভিড়ে-ঠাসা সভায় নাম না-করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কড়া ‘কটাক্ষ’ করে অধীর বলেন, “এই বাংলার সরকারকে বলতে চাই, কথায় বড় না-হয়ে যে কাজে বড় হয়, বাংলার মানুষ তাকেই মনে রাখে। কিষেণজিকে মেরে দিলাম! কৃতিত্ব দাবি করলাম। কিষেণজিকে মেরেছে যৌথ বাহিনী। কীসের কৃতিত্ব? ছিল ওয়েস্ট বেঙ্গল। করা হল পশ্চিমবঙ্গ। তাতে কৃষকের পেট ভরবে না!”
আরও একধাপ এগিয়ে বহরমপুরের কংগ্রেস সাংসদ বলেন, “আমাদেরই সমর্থন নিয়ে তারা ক্ষমতায় এল। এখন তারা বলছে, কংগ্রেসকে দরকার নেই। দরকার আছে কি নেই, সব চেয়ে ভাল জানেন সিপিএমের প্রকাশ কারাট। কেন্দ্রের থেকে সমর্থন তোলার পর সিপিএমকে বাইনোকুলার দিয়ে দেখতে হয়! তৃণমূলও এখন দিল্লি গিয়ে ফড়ফড় করছে এফডিআই (খুচরোয় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ) চলবে না বলছে। অথচ এফডিআই হলে কৃষককে আত্মঘাতী হতে হত না! কংগ্রেসকে গাল দেওয়া যায়, উঠিয়ে দেওয়ার কথা বলা যায়। কিন্তু যারা বলে, তারা বলতে বলতে নিজেরাই উঠে যায়!” |
অধীর যখন ওই কথা বলছেন, তখন মঞ্চে আসীন রাজ্য মন্ত্রিসভার তিন কংগ্রেসি সদস্য মানস ভুঁইয়া, আবু হেনা এবং মনোজ চক্রবর্তী। অধীরের সুরেই তৃণমূলের কড়া সমালোচনা করেন আবু হেনা এবং মনোজবাবু (তাঁরা দু’জনেই মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে নির্বাচিত বিধায়ক)। তবে খানিকটা ‘ভিন্নসুরে’ কথা বলেন মানসবাবু।
লালগোলার বিধায়ক, মৎস্যমন্ত্রী আবু হেনা বলেন, “৩৪ বছরের অপশাসন দূর করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্ব জোট সরকার গড়া হয়েছে। সরকারের সাতমাস হয়ে গেল। যাঁরা আমাদের নির্বাচিত করেছেন, তাঁদের কাছে মুখ দেখাতে পারছি না। কৃষক ধান-পাট-আলু-সব্জির দাম পাচ্ছে না। সরকারের দায়িত্ব রয়েছে। গুণগত পরিবর্তন যদি না-আনতে পারি, তবে এই মানুষই একদিন বিদ্রোহ করবে! সরকারের এক জন সদস্য হয়েও বলছি, কৃষক সহায়ক মূল্যে ধান বিক্রি করতে পারছে না, এটা ঘটনা। মুর্শিদাবাদে মেডিক্যাল কলেজ তৈরির প্রস্তাব ছিল। তাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে!”
মন্ত্রী মনোজবাবু বলেন, “এখানকার তৃণমূল এবং সিপিএম একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। মুর্শিদাবাদ জেলার তৃণমূল আসলে সিপিএমের বি-টিম। জেলাপরিষদ নিয়ে (ক্ষমতা হস্তান্তর) সিপিএমের আমলে যা হয়েছে, এই সরকারের আমলেও তা-ই হচ্ছে।” কৃষকদের কাছ থেকে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ধান-পাট-আলু কেনা হচ্ছে না অভিযোগ তুলে মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেসের তরফে সভা করা হয়েছিল। সহায়ক মূল্যে ধান কেনার বদলে এ জেলায় ‘নাটক’ হচ্ছে দাবি করে জোট সরকারের মন্ত্রী মনোজবাবু বলেন, “আমরা মন্ত্রিত্ব করব আর বাংলার চাষিভাইরা খেতে পাবে না, তা হতে পারে না! আমরা প্রতিকারের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে আন্দোলন করব।”
পশ্চিম মেদিনীপুরের সবং থেকে নির্বাচিত সেচমন্ত্রী মানসবাবুর সুর অবশ্য তুলনায় ‘নরম’ ছিল। তাঁর কথায়, “মন্ত্রী হিসাবে নয়, বলছি কংগ্রেসকর্মী হিসাবে। কারও বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে আসিনি। এসেছি কৃষকের পক্ষে আন্দোলন করতে। সাত-আটশো টাকায় কৃষক ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। বলব না? আলু-পাট বিক্রি করতে পারছে না। বলব না?” মমতার নাম না-করেই মানসবাবু আবেদনের সুরে বলেন, “সরকার পরিবর্তন হয়েছে। খাঁচাটির বদল হয়নি! পুলিশ-প্রশাসন-সরকারি কর্মীরা বদল হয়নি। পতাকাটা বদল হয়েছে মাত্র। ফলে কংগ্রেস যা বলছে, তা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ফেলে দেবেন না!”
মাসখানেক আগে বহরমপুরে দলীয় সমাবেশ করে অধীরকে ‘মুর্শিদাবাদের অধীশ্বর’ বলে কটাক্ষ করে গিয়েছিলেন তৃণমূলের সাংসদ তথা যুব তৃণমূল সভাপতি শুভেন্দু অধিকারী। বলেছিলেন, “আর ১৫ মাস অপেক্ষা করুন। মুর্শিদাবাদের অধীশ্বর হয়ে উঠবে একটাই দল তৃণমূল।” মন্ত্রী আবু হেনা তার পাল্টা দিয়ে এ দিন বলেন, “কেউ যদি মনে করেন মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেসকে শেষ করে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ দেবেন, তবে বলব, চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারি। মেদিনীপুর থেকে কে এসে কী বলে গেল, তাতে কিছু যায়-আসে না!”
শুভেন্দু বলেছিলেন, “মুর্শিদাবাদে এরা (কংগ্রেস) যতদিন থাকবে, ততদিন সিপিএমকে হটানো যাবে না। ওরাই সিপিএমকে অক্সিজেন যোগায়।” সভায় উপস্থিত শান্তিপুরের কংগ্রেস বিধায়ক অজয় দে তার জবাবে বলেন, “সিপিএমের হাতকাটা-গালকাটাদের নিয়ে কংগ্রেসকে শেষ করতে চাইছে তৃণমূল। তা কিন্তু হবে না।”
পিছিয়ে থাকেননি কংগ্রেসের পরিষদীয় নেতা মহম্মদ সোহরাবও। বুধবার, ৪ জানুয়ারি কলকাতায় রাজ্যের কৃষকদের অবস্থান বিক্ষোভ রয়েছে জানিয়ে জঙ্গিপুর থেকে নির্বাচিত বিধায়ক সোহরাব বলেন, “৩৪ বছরের বঞ্চনার বিরুদ্ধে জোট সরকার গড়েছি ঠিকই। কিন্তু ব্যথা-বেদনা নিয়ে দেখছি, এই সরকার ভুল পদক্ষেপ করছে। তার প্রতিবাদ করবই! চাষিদের ন্যায্য মূল্য দিতে সরকারকে বাধ্য করাব।”
এমনিতে অধীর-মমতার সম্পর্ক ‘অহি-নকুল’। গত বিধানসভা ভোটে তার আরও অবনতি হয় মুর্শিদাবাদে তৃণমূলের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের ‘গোঁজ’ প্রার্থী দাঁড়ানোয়। জোটের ফল ওই জেলাতে বাকি রাজ্যের তুলনায় যথেষ্ট খারাপ হয়। তবে ওই জেলা থেকে জেতা একমাত্র তৃণমূল প্রার্থী সুব্রত সাহাকে মমতা মন্ত্রী করেন। গত নভেম্বরের শেষে নেতাজি ইন্ডোরে কংগ্রেসের পঞ্চায়েতি-রাজ সম্মেলন থেকেও মমতার বিরুদ্ধে তোপ দেগেছিলেন অধীর। তবে তাঁর এ দিনের বক্তব্য সেদিনকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। সংসদে লোকপাল ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তৃণমূলের তরফে অধীরের বক্তব্য নিয়ে এ দিন কোনও আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করা হয়নি। তবে দলের নেতাদের একাংশ ‘তিক্ততা’ বৃদ্ধিরই আশঙ্কায়। |