|
|
|
|
অস্ট্রেলিয়া স্বাধীন হয়ে বর্ষশেষের অন্ধকূপে পুরে দিয়ে গেল ভারতকে |
গৌতম ভট্টাচার্য • মেলবোর্ন |
এখন সন্ধে ৭.১৫। খেলা শেষ হয়েছে বিকেল ৪.৪০।
ফটোগ্রাফাররা যে যাঁর মতো ছবি পাঠাতে অদৃশ্য। টিভি ক্যামেরাম্যানরাও কোনও কাজ নেই বলে মাঠ থেকে বেপাত্তা। এমসিজি গ্যালারি জনশূন্য। প্রেস বক্সের জনসংখ্যাও টিম টিম করছে। হঠাৎ দেখা গেল প্যাভিলিয়নের দিক থেকে একদল সাদা শার্ট, সাদা ট্রাউজার নাচতে নাচতে মাঠে ঢুকে পড়ল। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে হাতে বোতল। এরা কারা? ভিক্টোরিয়ার রাজ্য দল বা কোনও যুব টিম? এমন নাচানাচি-ফুর্তি-একে অপরকে শ্যাম্পেন ঢালাঢালি করছে কেন? এত বড় টেস্টের পর যুব দল অনুমতি পায় কী করে মাঠে ঢুকে পড়ার? মাঠের দু-তিন প্রান্ত থেকে নিরাপত্তারক্ষীরা ছুটে এসে আবার দাঁড়িয়ে গেলেন। গ্রুপটা তার মানে চেনা। প্রেস বক্সের দিকে মুখ করে এ বার তারা বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে পড়ল। হাডল। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে নাচ। এবং যেন আবির মাখানো হচ্ছে এ ভাবে একে অপরকে শ্যাম্পেন মাখানো। ভিড় থেকে একটা মুখ এ বার বেরিয়ে এসে গান ধরল, ‘বিনিথ দ্য সাদার্ন ক্রস আই স্ট্যান্ড...’
আরে এ তো মাইক হাসি!
পিছনে ওটা পন্টিং না? ফেনায় গোটা মুখ ভরে গিয়েছে। পিছনে ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ জেমস প্যাটিনসন। কাপড়চোপড়ের যা অবস্থা যেন সেন্ট কিলডা বিচ থেকে এখুনি তাঁকে ধরে আনা হল! এ বার বোধগম্য হল ব্যাপারটা। অস্ট্রেলিয়া বিজয়োৎসব করছে! কিন্তু এই পরিমাণ নাচানাচি আর উল্লাস তো সিরিজ জিতে উঠলে-টুঠলে করা হয়। চার টেস্ট সিরিজে ১-০ এগিয়ে গিয়ে এই পরিমাণ মহোৎসব। তা-ও কিনা মেলবোর্নে! যেখানে ভারত গত চার বারই টেস্ট ম্যাচ হেরেছে! আজ নিয়ে টানা ০-৫ হল।
চার তলার প্রেস বক্সে থাকা রিপোর্টাররা এতক্ষণে তৎপর হয়ে পড়েছেন। পায়ের যে ক্ষিপ্র নড়াচড়া দেখালে গৌতম গম্ভীরকে টেস্টে দ্বিতীয়বার উইকেটের পিছনে জঘন্য আউট হতে হত না, সেটা দেখিয়ে এক জন প্রেস বক্সের কাচের আস্তরণ ফাঁক করতে গেলেন। মোবাইল ক্যামেরায় সবাই ভিডিও করতে চান উল্লাসের এই বিরল মুহূর্ত। অসাধারণ ছবি হবে। |
|
‘দেওয়াল’ ভেঙে পড়ল। ভারতও। ছবি: এএফপি |
কিন্তু এমসিজি প্রেস বক্সের কাচ অস্ট্রেলীয় নতুন পেস বোলিংয়ের মতোই অনড় আর দুর্ভেদ্য। প্যাটিনসনরা যেমন অফ স্টাম্পের বাইরে এক জায়গায় ধারাবাহিক রেখে কখনও বাউন্স, কখনও সিম করালেন তেমনই কাঁচও নড়ল না। মাইকেল ক্লার্ককে ধরা গেল অতঃপর নীচে। নিজে ড্রাইভ করে হোটেলে ফেরার মতো অবস্থা তো নেই-ই। কথা বলার মতোও না। তারই মধ্যে ম্লান হেসে বললেন, “আজকের দিনটা সেলিব্রেশনের। শুধুই উল্লাসের। কাল থেকে আবার সিডনির শপথ। সিডনিটা সহজে ছাড়ছি না।”
মনে পড়ে গেল রিকি পন্টিংকে বিকেলের চ্যানেল নাইন ইন্টারভ্যুতে বলতে শুনেছি, “সিডনিতে ওরা বরাবর ভাল খেলে জানি। আর তাই এখানে একটু ঘাস ছাড়তে হবে এ বার।” কিন্তু সন্ধের পন্টিং সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। শ্যাম্পেনে তিনিও আত্মবিস্মৃত। যাঁর নেতৃত্বে টানা ১৬ টেস্ট জেতার বিশ্বরেকর্ড আছে তিনিও সিরিজের প্রথম টেস্ট ১২২ রানে জিতে এত আত্মহারা হয়ে পড়লেন?
একটাই সম্ভাব্য ব্যাখ্যা। কেপ টাউনে তাদের কুখ্যাত অল আউট ৪৭ এবং হোবার্টে আগের টেস্টে হার অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটকে অন্ধকূপে পুরে দিয়েছিল। মেলবোর্নে সচিন তেন্ডুলকরদের শেষ দিন এ ভাবে একপেশে হারিয়ে দেওয়ার পর ক্লার্করা তাই সপ্তম স্বর্গে। শুধু তো টেস্ট ম্যাচ জেতা নয়। গারদ থেকে বেরিয়ে আসা। যে অন্ধকূপে বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে নিক্ষিপ্ত ভারত। বর্ষশেষের টেস্ট ম্যাচ তাদের এমন হতাশায় ডুবিয়ে দিয়ে গেল যে সিডনিতে যদি আলোও আসে, সেটা ২০১২-তে হবে!
মেঘ ও রোদের অভূতপূর্ব সহাবস্থান এ বছরের ভারতীয় ক্রিকেটে। এ বারই বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন। আবার এ বছরই বিদেশে ছয় টেস্ট ম্যাচ খেলে টানা পাঁচ টেস্টে হার। স্কোরবোর্ডে থাকবে মেলবোর্নে ২৯২ তাড়া করতে নেমে ১৬৯ অল আউট। কিন্তু রোগের কারণ থাকবে না। কারণ লেখার ঘর থাকলে ‘সেম অ্যাজ অ্যাবাভ’ লিখতে হত।
ওপরের হারগুলোর মতোই কারণটা যে এক: গতিসম্পন্ন উইকেটে উঁচু মানের সিম বোলিং খেলতে না পারা।
বিপক্ষে কোনও গ্লেন ম্যাকগ্রা নেই। কোনও ব্রেট লি নেই। নতুন ভাবে তৈরি চাপে থাকা একটা টিমের বোলিং আক্রমণ। যারা কী করতে পারে সেই কম্বিনেশন প্রস্তুতকারকেরাও ঠিকঠাক জানে না। অথচ তারাই ছয় উইকেট ফেলে দিয়েছিল ৮১ রানে। রবিচন্দ্রন অশ্বিন না দাঁড়ালে স্কোর একশো পার হত না। অশ্বিন প্রথম ইনিংসে করলেন ৩০। চতুর্থ সর্বোচ্চ রানকারী। দ্বিতীয়তে ৩১। রানসংখ্যায় সচিনের পরেই। বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইন আপ হিসেবে মহাপ্রসিদ্ধ টিমের যদি আট নম্বর প্লেয়ার এই জায়গায় থাকে, তা হলে ওপরে বড়রকমের কোনও টেকনিক্যাল গণ্ডগোল যে হচ্ছে, নিশ্চিত।
রাহুল দ্রাবিড়ের মতো টেকনিক্যালি নিখুঁত ব্যাটসম্যান। তিনি কিনা পরপর দু’বার বোল্ড হলেন ব্যাট-প্যাডের মাঝ দিয়ে। প্রথম ইনিংসে একবার নো বলে আউট হয়ে বেঁচে যাওয়া ধরলে সংখ্যাটা তিন হয়। অথচ ১৬১ টেস্ট ম্যাচ খেলা রাহুল একই টেস্টের দু’ইনিংসে বোল্ড হচ্ছেন এমন ঘটনা ক্কচিৎ। এক আঙুলে গোণা যায়। বীরেন্দ্র সহবাগ? আর সব দেশের মতো তাঁকে অস্ট্রেলিয়াও ভয় পায়। কিন্তু আট বছর আগে এ মাঠের যে পিচে সহবাগ ১৯৫ করেছিলেন, সেই পিচ মোটেও এ বারের মতো জীবন্ত ছিল না। এ ধরনের উইকেটে চোখ সেট না করে উদ্ধত মারের খেলা যে সম্ভব নয় ২০১১-তে তিনি বারবার দেখলেন। ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া সর্বত্র। ২০১২-তে কি শিক্ষা নেবেন? আর গৌতম গম্ভীরকে দেখে মনে হচ্ছে অন্তত অস্ট্রেলিয়ায় তাঁর মনোবিদ লাগবে। একেবারেই আত্মবিশ্বাসশূন্য। বিরাট কোহলি হতাশ করেননি। যদিও আক্রম রেগেমেগে বলছিলেন, “চ্যাংড়ামি করছে নাকি? অস্ট্রেলিয়ায় এই পায়ের মুভমেন্টে পেস বোলার খেলবে!” আক্রম জানেন না কোহলির উপমহাদেশের বাইরে টেস্ট ম্যাচে সাফল্য-সম্ভাবনা নিয়ে বহুদিন গুঞ্জন চলছে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় খেলা ছেড়ে দেওয়ার তিন বছর হয়ে গেল। এখনও তাঁর ছ’নম্বরের জায়গাটা ভর্তি হল না। এ দিন চ্যানেল নাইন বক্সের সামনে তাঁকে একজন জিজ্ঞেস করলেন, ইন্ডিয়া তো ছ’নম্বর খুঁজছে। যাবেন নাকি? সৌরভ বললেন, “সিওর। ইংল্যান্ড ট্যুরের সময় ভুঁড়ি ছিল। সেটা ঝরিয়ে ফেলেছি। রঞ্জিতে পাঁচশোর কাছাকাছি রান করেছি। আমি রেডি।” মুখে হাসি। কিন্তু বোঝা যায় আজও ভেতরে মর্মান্তিক বেদনা। সামান্য আঁচড়েই রক্ত ঝরে।
সচিন তেন্ডুলকর রান তাড়া অবধি নিয়ে যেতে হয়তো পারতেন না। উল্টোদিকে সঙ্গী এক এক করে ঝরে যেত। কিন্তু চতুর্থ ইনিংসে চাপের মুখে এই টেস্টে তাঁর আরও দাঁড়ানো উচিত ছিল। শুরু করেছিলেন চমৎকার। প্রথম বাউন্ডারি থেকেই মাঠে প্ল্যাকার্ড দোলানো শুরু হল---‘সচিন স্মৃতির জন্য অজস্র ধন্যবাদ’। মনে পড়ে গেল এমসিজি-তে এটাই তাঁর শেষ ইনিংস। চতুর্দিকে উইকেট পতনের মধ্যে তখন তেন্ডুলকরকে নিশ্চল আর অভিজাত দেখাচ্ছে। এবিসি রেডিও-র ভাষ্যকার প্রায় ডিস্ক জকির মতো আবেদন করলেন, “মেলবোর্নবাসীরা, আপনারা যে যেখানে আছেন, এমসিজি-তে আসুন! এখানে ব্যাটিং এক্সিবিশন হচ্ছে।” কেউ তখন ভাবেননি ইনিংসটা যে আচমকা ৪৬ বলে ৩২ রানে এ ভাবে শেষ হয়ে যাবে! ফেরার সময় গোটা এমসিজি বিদায়ী অভিবাদন দিল তাঁকে। মনে হয় না ওয়ান ডে সিরিজ আর খেলবেন বলে। সে ক্ষেত্রে আজই শেষ। কিন্তু সচিন লজ্জায় এ বার আর ব্যাট তুললেন না। দলকেই টানতে পারলেন না। নিছক ব্যক্তি মাহাত্ম্য স্বীকার করতে যাবেন কেন টিম গেমে!
ভাবা হয়েছিল অনভিজ্ঞ অস্ট্রেলীয় আক্রমণ বিপক্ষের মহারথীদের সামনে ‘চোক’ করে যেতে পারে। আদৌ করেনি। বরঞ্চ সিডল-হিলফানোস-প্যাটিনসনরা এমন ফুলকি ছোটালেন যে সিডনিতে না অস্ট্রেলিয়া চার ফাস্ট বোলার নামিয়ে দেয়।
বর্ষশেষের সত্য তো সবাই জেনে গিয়েছে। সত্যিটা বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইন আপ নয়। সত্যি হল প্রচণ্ড গতির সিম আক্রমণের সামনে ভারতীয়দের অনিবার্য মুখ থুবড়ে পড়া।
|
অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংস: ৩৩৩
ভারত প্রথম ইনিংস: ২৮২
অস্ট্রেলিয়া দ্বিতীয় ইনিংস: (আগের দিন ১৭৯-৮) |
হাসি ক ধোনি বো জাহির ৮৯
প্যাটিনসন নঃআঃ ৩৭
হিলফেনহস ক লক্ষ্মণ বো ইশান্ত ১৪
অতিরিক্ত ১৩।
মোট ২৪০ (৭৬.৩ ওভারে)।
পতন: ১৩, ১৬, ২৪, ২৭, ১৪২, ১৪৮, ১৬৩, ১৬৬, ১৯৭, ২৪০।
বোলিং: জাহির ২০-৪-৫৩-৩, উমেশ ২০-৪-৭০-৪, ইশান্ত ১১-০-৪৩-২,
অশ্বিন ২২-৪-৬০-১, সহবাগ ২-০-৭-০।
|
ভারত দ্বিতীয় ইনিংস |
গম্ভীর ক পন্টিং বো সিডল ১৩
সহবাগ ক হাসি বো হিলফেনহস ৭
দ্রাবিড় বো প্যাটিনসন ১০
সচিন ক হাসি বো সিডল ৩২
লক্ষ্মণ ক কাওয়ান বো প্যাটিনসন ১
কোহলি এল বি ডব্লিউ হিলফেনহস ০
ধোনি বো প্যাটিনসন ২৩
অশ্বিন ক কাওয়ান বো সিডল ৩০
জাহির ক কাওয়ান বো প্যাটিনসন ১৩
ইশান্ত নঃআঃ ৬
উমেশ ক ওয়ার্নার বো লিয়ঁ ২১
অতিরিক্ত ১৩।
মোট ১৬৯ (৪৭.৫ ওভারে)।
পতন: ১৭, ৩৯, ৫৮, ৬৮, ৬৯, ৮১, ১১৭, ১৪১, ১৪২।
বোলিং: প্যাটিনসন ১৫-২-৫৩-৪, হিলফেনহস ১৮-৪-৩৯-২,
সিডল ৯-১-৪২-৩, লিয়ঁ ৫.৫-০-২৫-১। |
|
|
|
|
|
|
|