মানুষ চিন্তাশীল জীব। তাহা লইয়া স্বভাবতই মানুষের গর্বের শেষ নাই। অপরাপর প্রাণীদের চাহিতে চিন্তাকুশলতায় মানুষ মহত্তর। ইহা সত্য। তবে কোনও বিষয়েই বাতিক ভাল নহে। মুশকিল হইল, যাহা গুণ হইতে পারিত তাহা অতি-আচরণে বিপত্তি ঘটাইতে পারে। চিন্তা লইয়া মানুষ অতি বিপত্তিতে পড়িয়াছে। অন্য জনগোষ্ঠীর কথা থাক। চিন্তাই যে বাঙালির উত্থান ও পতনের কারণ তাহা কে না বলিবে। বঙ্গজগণ যেখানে চিন্তাশীল সেখানে তাহারা চিন্তাকে কাজে রূপায়িত করিয়াছে। বাঙালি চিন্তকদের সেখানে যথেষ্ট কদর। কিন্তু আমবাঙালি সুচিন্তক নহেন, তাঁহারা চিন্তাবায়ুগ্রস্ত। হা চিন্তা জো চিন্তা করিয়া মুখ শুকাইয়া বসিয়া থাকেন। কৃশ হইতে কৃশতর হন। কাজের বালাই নাই কী করিব আর না করিব তাহা লইয়া অষ্টপ্রহর কাটিয়া যাইতেছে। কিছু আর করিয়া ওঠা হইতেছে না। চিন্তা করাকেই বাঙালি কাজ বলিয়া ভাবিতে শিখিয়াছে, যেন কাজের চিন্তা করিলেই কাজ করা হইয়া গেল! এই চিন্তাক্লিষ্টদের লইয়া রবীন্দ্রনাথ ফুট কাটিয়াছিলেন। ঠিকই করিয়াছিলেন। বিবেচনার দাপটে জাতিকুল শুকাইয়া গেল।
হালে বিজ্ঞানীরা চিন্তার বায়ু ও ব্যাধি লইয়া আর এক দিক হইতে বিচার করিতে বসিয়াছেন। তাঁহাদের বক্তব্য, চিন্তার দাপট সত্যই শরীরের ক্ষতি করে। তাঁহারা কতকগুলি পর্যায়ে বিষয়টি বিচার করিতে তৎপর। কোনও অনভ্যস্ত পরিবেশে মানুষ মানাইয়া লইতে না পারিলে চিন্তান্বিত হইয়া পড়েন। সেই পরিবেশে মানাইবার প্রয়াস ব্যর্থ হইলে এক ধরনের প্রতিরোধ-ইচ্ছা গড়িয়া উঠে। শুধু তাহাই নহে। চিন্তা শব্দটি নানার্থক, তাহা মনে রাখিয়াই বলা চলে, আত্যন্তিক আকার ধারণ করিলে শরীরে যে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে তাহা ক্ষতিকর। এমনকী অতিচিন্তায় মৃত্যু পর্যন্ত হইতে পারে। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা যাহা পরীক্ষা করিয়া বলিয়াছেন তাহা বাঙালির সমাজজীবনে নানা সময়ে চোখে পড়িয়াছে। জাতি হিসাবে বাঙালির একটি চরিত্রলক্ষণই এখানে নিহিত
এই স্বভাবের একটি পরিণাম হইয়াছে বাঙালির বিচ্ছিন্নতা। প্রতিকূল বিপরীত পরিবেশে বঙ্গজগণ মানাইয়া লইতে পারেন না। অপর প্রদেশে গিয়া বাঙালিরা নিজেদের গোষ্ঠীতন্ত্র বজায় রাখে, সেই প্রদেশের মানুষদের সঙ্গে মেলা-মেশা করে না। ইংরেজ আমলে বঙ্গজগণ নানা কারণে অন্য প্রদেশে সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল। ফলে গোষ্ঠীতন্ত্র বজায় রাখা সম্ভব হইয়াছিল। কিন্তু পরে না মিশিয়া আত্মকেন্দ্রিকতা বজায় রাখার ফলে বাঙালি বিপদে পড়িয়াছে। অপর জাতের মানুষের সঙ্গে মিশিব কী করিয়া, তাহা লইয়া ভাবিয়া কুল পায় নাই। আর শুধু তাহাই নহে বহু ক্ষেত্রে চিন্তাবিলাসে দিন কাটাইয়াছে, হেতুহীন ভাবে চিন্তা অতি মহৎ কর্ম এই ধুয়া তুলিয়া হাত গুটাইয়া বসিয়া থাকিয়াছে। সুতরাং চিন্তা থাক, এবার কাজ শুরু হউক। বিজ্ঞানীরা ইঁদুরদের উপরে পরীক্ষা করিয়া যাহা সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, তাহা বঙ্গজীবনে সত্য ঐতিহাসিক সত্য। সুতরাং বাঙালির সচেতন হইবার সময় আসিয়াছে। নূতন বছরে চেতনা জাগিবে কি? |