অণ্ণা হজারে নির্ধারিত সময়ের আগেই অনশন তুলিয়া লইয়াছেন। এবং জানাইয়াছেন, তাঁহার লড়াই শেষ হয় নাই, ইহা সাময়িক বিরতি, আগামী বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনে তিনি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রবল প্রচারে অবতীর্ণ হইবেন। মুম্বইয়ে তাঁহার অনশনভূমিতে জনসমাগমের এমন শোচনীয় ঘাটতি দেখা না দিলে অণ্ণা হজারে অনশন প্রত্যাহার করিতেন কি না, সেই জল্পনা নিষ্প্রয়োজন। তাঁহার এই সিদ্ধান্তের তাৎপর্য বিপুল। প্রতীকী তাৎপর্য। আপন পছন্দ মাফিক লোকপাল বিল পাশ করাইবার জন্য তিনি যে পদ্ধতিতে যে ভঙ্গিতে আন্দোলন করিতেছেন তাহাকে জবরদস্তি বলিলে অত্যুক্তি হয় না। এই জবরদস্তির দুইটি উপকরণ। এক, অনশন নামক ‘হুমকি’। দুই, ভিড় জমাইয়া চাপ সৃষ্টি। অর্থনীতিবিদ যাহাকে ‘রাস্তার জাস্টিস’ বলিয়া সমালোচনা করিয়াছেন, অণ্ণা হজারে ও তাঁহার পারিষদ এবং অনুগামীরা সেই পথেরই পথিক। সুতরাং তাঁহার ‘রণে ভঙ্গ’ দেওয়ার ঘটনায় এই চাপসৃষ্টির রাজনীতির ব্যর্থতা প্রমাণিত হইল, অন্তত সাময়িক ব্যর্থতা। পাশাপাশি, লোকপাল বিল লইয়া সংসদে যে বিতর্ক এবং আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া চলিতেছে, তাহাই প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের স্বীকৃত এবং মান্য প্রক্রিয়া। সেই কারণেই লোকপাল বিতর্কের সংসদীয় সমাধানের উদ্যোগটি ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে বিশেষ সুলক্ষণ। এবং এই পরিপ্রেক্ষিতেই বলিতে হয় যে, অণ্ণা হজারে যদি সত্যই এই প্রশ্নে নির্বাচনী প্রচারে অবতীর্ণ হন, বা আর এক কদম অগ্রসর হইয়া দুর্নীতি নির্মূল করিবার আহ্বান জানাইয়া কোনও রাজনৈতিক দলের শরিক হিসাবে অথবা নূতন রাজনৈতিক দল গঠন করিয়া কিংবা নির্দল মঞ্চ হইতে রাজনৈতিক সংগ্রামে যোগ দেন, তবে আনন্দিত হইবার যথেষ্ট কারণ থাকিবে। কারণটি ইহাই যে, তাহা হইবে সংসদীয় রাজনীতির জয়। এবং তাহাতে সংসদীয় রাজনীতিই পুষ্ট ও শক্তিমান হইবে।
তাহার অর্থ এই নয় যে, অণ্ণা হজারেরা যাহা চাহিতেছেন, তাহা সত্যই অভীষ্ট। লোকপাল বা লোকায়ুক্তের ধারণাটিই অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু তাহা ভিন্ন প্রশ্ন। গণতন্ত্রে বহু মতের স্থান থাকিবে, ইহাই স্বাভাবিক। ভারতীয় গণতন্ত্রের সাফল্যের প্রধান কারণ ইহাই যে, তাহা বহু মতকে স্থান দিয়াছে। কালক্রমে জাতপাত, আঞ্চলিকতা ইত্যাদি বিবিধ দিক হইতে এই রাজনীতি ভাঙিয়াছে, খণ্ডিত হইয়াছে, আবার সেই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়াই তাহা ব্যাপ্তি ও গভীরতা অর্জন করিয়াছে, বহিমাত্রিক ভারতীয় সমাজকে ধারণ করিতে সক্ষম হইয়াছে। ইহাই একটি গণতন্ত্রের পরিণত হইয়া উঠিবার প্রক্রিয়া। অণ্ণা হজারে ও তাঁহার সমর্থকরা যে আপন মতামত ঘোষণা করিয়া সরকারের উপর দাবি জানাইতে পারিতেছেন, সেই অধিকার ভারতীয় গণতন্ত্রই তাঁহাদের দিয়াছে। ইহাই বহুমত প্রকাশের অধিকার। কিন্তু এই অধিকারকে কেবল নিষ্ক্রিয় ভাবে অভিবাদন জানাইলে গণতন্ত্রের দায়িত্ব ফুরায় না। ইহাকে মর্যাদা দিবার এবং সমৃদ্ধ করিয়া তুলিবার জন্য সংসদীয় রাজনীতির অনুশীলন জরুরি। সেই অনুশীলনের দায়িত্ব অবশ্যই সাংসদ ও বিধায়কদের, তথা সাধারণ ভাবে রাজনীতিকদের। সংসদে এবং বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভায় অনেক প্রতিনিধিদের আচরণে অনেক সময়েই এই দায়িত্ববোধের যথেষ্ট প্রতিফলন দেখা যায় না। বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে যথার্থ বিতর্ক হয় না, অথবা আদৌ কোনও আলোচনাই হয় না। সংসদের অধিবেশন বসিবার পরে দিনের পর দিন, এমনকী কার্যত গোটা অধিবেশনই দলীয় বিবাদে, চিৎকারে, ধস্তাধস্তিতে, অথবা বয়কটের তাড়নায় বানচাল হইয়া যায়। বস্তুত, সংসদের অভ্যন্তরেও দেখা যায় রাস্তার রাজনীতির প্রসার। গণতন্ত্রের মর্যাদা রক্ষার দায় কেবল অণ্ণা হজারেদের নহে, সাংসদদেরও। লোকপাল বিলের ক্ষেত্রে অন্তত তাঁহাদের আচরণে সেই দায়িত্ব পালনের কিছু চেষ্টা দেখা গিয়াছে, হয়তো ‘রাস্তার রাজনীতি’র চাপেই। কিন্তু এই দৃষ্টান্ত অন্য ক্ষেত্রেও, সাধারণ ভাবে সমস্ত ক্ষেত্রেই প্রসারিত হওয়া জরুরি। সংসদীয় রাজনীতি যত স্বাস্থ্যবান ও দায়িত্বশীল হইবে, বৃহত্তর সমাজের নিকট সাংসদদের বিশ্বাসযোগ্যতা তত বাড়িবে, ফলে সংসদের বাহিরে চাপ সৃষ্টি করিয়া দাবি আদায়ের তৎপরতাও তত কমিবে। আশা করা যায়, সাংসদরা এই শিক্ষাটি গ্রহণ করিয়াছেন। |