এক কালের ‘লাল দুর্গ’ বর্ধমানে তিন হাজারেরও বেশি দলীয় সদস্যের পদ খারিজ করে দিল সিপিএম! তৃণমূলের সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠতা’র অভিযোগে বহিষ্কার করা হয়েছে ১৭ জন নেতাকে। দুর্গাপুরে সিপিএমের জেলা সম্মেলন চলার ফাঁকে বৃহস্পতিবার এমনই জানিয়েছেন দলের জেলা সম্পাদক অমল হালদার। আজ, শুক্রবার সম্মেলন শেষে গাঁধী ময়দানে সমাবেশে বক্তৃতা করার কথা দুই পলিটব্যুরো সদস্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও নিরুপম সেনের।
লোকসভা থেকে শুরু করে পরের পর নির্বাচনে দলের হারের পর সারা রাজ্যের মতো এই জেলাতেও ‘শুদ্ধকরণ’ প্রক্রিয়া চলছে। তারই অঙ্গ হিসাবে দলীয় সদস্যদের উপরে ‘নজরদারি’ চালিয়ে তিন হাজারেরও বেশি কর্মীর সদস্যপদ খারিজ করা হয়েছে বলেই দলীয় সূত্রের ব্যাখ্যা। তবে ‘শুদ্ধকরণে’র প্রক্রিয়ার মধ্যেও এক ধাক্কায় এত জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দৃষ্টান্ত আরও কোনও জেলায় প্রকাশ্যে আসেনি। প্রসঙ্গত, বর্ধমান জেলায় এখন সিপিএমের সদস্য সংখ্যা প্রায় ২১ হাজার।
জেলায় দলীয় সংগঠন ঢেলে সাজার কাজে এখন গুরুত্ব দিচ্ছেন অমলবাবুরা। তবে অন্যত্র কমিটির সংখ্যা কমলেও বর্ধমানে জোনাল কমিটির সংখ্যা ২৪ থেকে বাড়িয়ে ২৬ করা হয়েছে। মেমারি ভেঙে মেমারি-১ ও জামালপুর এবং হিরাপুর-কুলটি ভেঙে পৃথক হিরাপুর ও কুলটি জোনাল কমিটি গড়া হয়েছে। সাংগঠনিক ভাবে অভিজ্ঞ এবং মতাদর্শগত ভাবে শিক্ষিত কম-বয়সীদের সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। অমলবাবুর বক্তব্য, “প্রবীণ ও নবীনদের সম্মিলিত উদ্যোগে পরিচালিত হবে সংগঠন।” তিনি জানান, রাজ্য কমিটির নির্দেশিকা মেনেই ছোট কিন্তু ‘কার্যকরী’ জেলা কমিটি হবে। সর্বোচ্চ ৭০ জনের সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। জেলা কমিটির বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৮৮।
বর্ধমানে দল ‘পুনর্গঠনে’র প্রয়াস আরও উল্লেখযোগ্য এই কারণে যে, দীর্ঘ কাল এই জেলার পরিচিতি ছিল ‘লাল দুর্গ’ হিসাবেই। নিরুপমবাবু, বিনয় কোঙার, মদন ঘোষদের নেতৃত্বে রাজ্য সিপিএমে এই জেলা কমিটির ‘গুরুত্ব’ যথেষ্ট বেশি। এই জেলার নেতাদের প্রতাপ এক সময় এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, রাজ্য কমিটিতে ‘বর্ধমান লবি’ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও এই ‘লবি’র প্রভাব ছিল যথেষ্ট। শেষ পঞ্চায়েত ভোটে রাজ্যে যখন তৃণমূল ক্ষমতা বিস্তার করতে শুরু করে, তখনও বর্ধমানে তার বিশেষ আঁচ পড়েনি। জেলার ২৭৭টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ২০২টিই ছিল বামেদের দখলে। ২০০৯-এ ‘পরিবর্তনের হাওয়া’র মধ্যেও লোকসভা ভোটে জেলার তিনটি আসনেই জেতে সিপিএম।
কিন্তু ধস নামতে শুরু করে ২০১০-এর পুরভোট থেকে। বিনয়বাবুর খাস তালুক মেমারিতে সিপিএমের দখলে-থাকা পুরসভার ১৬টি আসনই জিতে নেয় কংগ্রেস-তৃণমূল। সিপিএমের হাতছাড়া হয় কালনা ও দাঁইহাট পুরসভাও।
বিপর্যয় আরও ঘনীভূত হয়ে গত বিধানসভা ভোটে জেলার ২৫টির মধ্যে মাত্র ৯টি আসন পায় বামেরা। যেখানে পুনর্বিন্যাসের আগে জেলার ২৬টির মধ্যে ২৩টিই ছিল তাদের! বিধানসভা ভোটে ভরাডুবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য বর্ধমান দক্ষিণ কেন্দ্রে বিগত সরকারের শিল্পমন্ত্রী নিরুপমবাবুর প্রায় ৩৬ হাজার
ভোটে পরাজয়।
বিধানসভা ভোটের পর থেকে জেলায় সিপিএমের ‘প্রতাপ’ ক্রমেই ক্ষীণ হতে থাকে। সংগঠনের হাল ফেরাতে নানা স্তরে নেতৃত্বে রদবদল ঘটাতে শুরু করে সিপিএম। সম্প্রতি বর্ধমান শহরের ১৭ জন ‘লড়াকু’ নেতাকে জোনাল ও চারটি লোকাল কমিটি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতেই বুধবার থেকে শুরু হয়েছে তিন দিনের জেলা সম্মেলন। উদ্বোধন করেছেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মদনবাবু। যোগ দিয়েছেন ৫৪৪ জন প্রতিনিধি। প্রত্যাশিত ভাবেই, সম্মেলনে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের সমালোচনা করছেন প্রতিনিধিরা। সমালোচনা হচ্ছে বর্তমান রাজ্য সরকারের শিল্পনীতিরও। অমলবাবুর কথায়, “জমির মালিকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে রাজ্য সরকার জমির ব্যবস্থা করে দিতে না-পারলে শিল্পপতিরা কখনওই শিল্প গড়তে পারবেন না। কারণ, এক লপ্তে জমি পাওয়াটাই সমস্যা। শিল্প না-হলে রাজ্যে বেকারি বাড়বে।” আর্থিক মন্দার কারণে বর্ধমানের গোদায় প্রস্তাবিত স্বাস্থ্যনগরী গড়তে না-পারা বিধানসভা ভোটে নিরুপমবাবুর হারের অন্যতম কারণ বলে মন্তব্য করেন তিনি। তাঁর মতে, দলীয় সদস্যদের অনেকের ‘নিষ্ক্রিয়তা’, নির্দেশ মেনে কর্মসূচিতে অংশ না-নেওয়া, বিরোধীদের ভুল প্রচারে মানুষের বিভ্রান্ত হওয়া-সহ নানা কারণ বিধানসভা-বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। |