“ইট্স অল হ্যাপেনিং আউট দেয়ার ইন দ্য মিডল,” কোন ক্রিকেট ভাষ্যকারের প্রিয়তম অভিব্যক্তি?
ভাল মাপের স্পোর্টস কুইজে প্রশ্নটা হবেই না। মোটামুটি পাতে দেওয়া যায় এমন কুইজারের কাছে যে হাফভলি! উত্তর বিল লরি। সোমবার অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় উইকেট পড়া মাত্র জনতার কিচিরমিচির আরও ঊর্ধ্বগামী। এমনকী পুরু কাঁচের বাক্স ঠিকরে প্রেস এনক্লোজারে পৌঁছচ্ছে ব্যাকুল চিৎকার। চ্যানেল নাইন কমেন্ট্রিতে ঠিক এই সময় বিল লরি তাঁর ফেভারিট শব্দগুচ্ছ প্রয়োগ করলেন। সহ-ভাষ্যকার তখন টনি গ্রেগ। তিনি বিশেষ প্রভাবিত নন। বরঞ্চ লরিকে জিজ্ঞেস করলেন, “মিডলটা কোন মাঠের? এমসিজি না ইডেন গার্ডেন্স?”
খুব সঙ্গত প্রশ্ন। কেন? কালকের ওই রকম দুর্যোগ সামলে সোমবার মেলবোর্নের মাঠে ঠিকঠাক সময় খেলা শুরু হয়ে গেল এটা যদি চমকপ্রদ হয়, তার পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে থাকবে বক্সিং ডে-র দর্শক সমীকরণ। ইংল্যান্ডের মাঠে এখন ভারতীয়রা প্রচুর সংখ্যায় আসেন। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় কবে তাঁরা এমন সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠলেন? এক-এক সময় তো বোঝাই যাচ্ছিল না যে, ধোনিরা দেশে খেলছেন? না ঘোর বিদেশে? হোম সিরিজ না অ্যাওয়ে?
ম্যাচ অনেক আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জীবনের উত্তাপ প্রথম পাওয়া গেল ভারতীয় সময় সকাল ৬.২০-তে। যখন রিকি পন্টিং নেমে পড়লেন! কেউ যেন নীরবে শিঙা ফুঁকে দিল প্রথম দিনের সবচেয়ে নাটকীয় আড়াই ঘণ্টা! এমনিতে এ দেশে বক্সিং ডে টেস্ট ম্যাচ দেখতে আসা সামাজিক উপাচারের অঙ্গ দাঁড়িয়ে গিয়েছে। নিউ ইয়ারে কলকাতায় অনেকে যেমন ঘোড়ার মাঠটা কী বস্তু, ছোঁয়ার জন্য হাল্কা একটু ঘুরে আসতে চায়, এখানেও তেমনই। বড়দিন মানে বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ কাটাবে। আর বক্সিং ডে-তে উল্টো। সম্পূর্ণ আউটডোর সুখী জীবন। বিচে যাবে। ক্রিকেট দেখবে। রাতে বাড়ি ফিরে বার্বিকিউ করবে।
পন্টিং নামতেই অবশ্য বোঝা গেল মহাতারকার রক্তমাংসের বিপন্নতা আর তাঁকে জীবনযুদ্ধে পতনের মুখে লড়তে দেখাটা এমন আবেগ যে, কোনও উপাচার-টুপাচারে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না। পন্টিং নামতেই যা হাততালি কুড়োতে শুরু করলেন, মনে হতে লাগল আজই যেন তাঁর বিদায়ী ইনিংস! |
উত্তেজনার ঘনঘটা তো দিনভরই ছিল। সি-স’র মতো শাঁ করে ম্যাচ এক দিকে উঠল। আবার সে দিকটা নেমে গেল। ২ উইকেটে ৪৬ থেকে একেবারে ১৫৯। তার কিছুক্ষণ পর হঠাৎ আবার ১৯ বলে ৩ উইকেট! অস্ট্রেলিয়া ২১৪-৬। দ্রুত ধসে পড়তে পড়তে আবার এমন মরিয়া চিরপরিচিত অস্ট্রেলীয় সংগ্রাম যে ৫০-৫০ হয়ে প্রথম দিন সমাপ্ত। কেউ এগিয়ে নেই। কেউ পিছিয়ে নেই। কলকাতায় দুধওয়ালারা যে সময় বাড়ি বাড়ি দুধ দিয়ে যায়, আনুমানিক সেই সময় মঙ্গলবার বোঝা যাবে নতুন বলে কাজ হল? নাকি অস্ট্রেলিয়া এগিয়ে গেল ম্যাচে?
কিন্তু এ সব নাটক তো টেস্ট ম্যাচে হামেশাই হয়। রোজকার কাহিনি। টেস্ট ক্রিকেটে ১২৬৫৬ করা একটা লোক যদি যাবতীয় অনিশ্চয়তা আর সংশয়ের মধ্যে নেমে নিজের প্রিয় পিচে সেকেন্ড বল খটাং করে হেলমেটে খেল, সেটা তো রোজ হয় না। কেউ জানেও না তখন কী অবস্থা হতে পারে তার। এত দিনকার অহঙ্কার তো ধুলোয় লুটিয়ে যাওয়ার অবস্থা। উমেশ যাদবের বলটা এত জোরে লাগল যে, নন-স্ট্রাইকার এড কাওয়ান দৌড়ে গেলেন ও দিকে। “রিকি, ঠিক আছ?” উত্তর পেলেন, “ঠিক আছি।” বিপন্ন প্রাক্তন সেনাধ্যক্ষের মর্যাদাযুদ্ধের গন্ধে তখন ম-ম করছে গোটা এমসিজি। ধোনি ক্লোজ-ইনই শুধু বাড়ালেন না। আরও শর্ট পিচ শুরু হল। একই টাকায় তখন রুদ্ধবাক জনতা দু’টো শো দেখছে। একটা টেস্ট ক্রিকেটের। অন্যটা পেশাদারি গর্ব উদ্ধারের। প্রেসবক্সের ঠিক পাশেই টিভি চ্যানেলের পরপর ঘরগুলো। তার বাইরে ছোট লাউঞ্জ। কমেন্ট্রি না থাকলে মিডিয়া ওখানেই বসে চা-টা খায়। গুলতানি করে। কিন্তু এখন তো যাঁরা কমেন্ট্রি করছেন না, তাঁরাও খেলা দেখতে স্টুডিওয় ঢুকে গেলেন। রিচি বেনো। মার্ক টেলর। সৌরভ। আক্রম। জেফ লসন। টম মুডি। আড্ডা বন্ধ।
প্রেসবক্সে তার একটু আগেই পন্টিংয়ের খুব ঘনিষ্ঠ মানুষের মুখে শুনছিলাম, ভেতরে ভেতরে তিনি স্টিভ ওয়-কে ভীষণ অপছন্দ করেন। শেন ওয়ার্নের মতো কখনও প্রকাশ্য হননি। কিন্তু বন্ধুদের বার বারই বলেছেন, স্টিভ খুব স্বার্থপর। যাবতীয় চাপ-টাপ কমে গেলে পাঁচ নম্বরে আসত। আসল লক্ষ্য ছিল, নট আউট থেকে কী করে নিজের টেস্ট গড়টা পঞ্চাশের ওপর রেখে দেবে। ভদ্রলোকের নাম লিখলাম না। এটুকু জানাতে পারি কথাগুলো খুব আশ্চর্য মনে হলেও তাঁকে অবিশ্বাসের কোনও কারণ নেই।
আজ যেমন এটাও অবিশ্বাসী হয়ে দেখতে হল পন্টিং ব্যাট করছেন স্টিভের মতো। পড়তি ফর্ম বা চাপ যেটাই কারণ হোক তাঁর সেই বক্সারদের মতো বিখ্যাত ফুটওয়ার্ক কাজ করছে না। অনায়াস সেই ব্যালান্সটাই আসছে না স্ট্রোক মেকিংয়ে। সাইডওয়েজ গিয়ে পুল শটটা চিরকাল এত অসম্ভব ভাল মারেন, সেটা ঠিক মতো ছুটছে না। অথচ তাঁকে নড়ানোও যাচ্ছে না। স্টিভোচিত খাড়ুর প্রতিজ্ঞায় এমন পড়ে আছেন, যখন পঞ্চাশ করলেন মনে হল ডাবল সেঞ্চুরির হর্ষধ্বনি শুনছি। ‘দ্য অস্ট্রেলিয়ান’-এর ম্যালকম কন তখন আনন্দবাজারের সঙ্গে শেয়ার করছেন পন্টিং কভারেজ নিয়ে তাঁদের যন্ত্রণার কথা! বলছেন, প্রাক্তনদের মধ্যে সব নক্ষত্র ক্রিকেটারই মনে করেন, ওর সরে যাওয়া উচিত। কিন্তু কেউ মুখে বলবে না। সবাই বিল ওরিলি মডেল নিয়েছে। কী মডেল, না ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’-এ ব্র্যাডম্যানের খুব সুখ্যাতি করে একদা ওরিলি কলম লেখায় নিউজ ডেস্ক বিস্মিত হয়ে যায়। তিনি না ক্রিকেটজীবনে ডনের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন? ওরিলি তখন তাঁদের বুঝিয়েছিলেন, “শোনো ভাইরা, স্ট্যাচু যখন হয়ে গিয়েছে ছেড়ে দাও। স্ট্যাচুর ওপর হিসি করতে নেই!”
পন্টিংয়ের স্ট্যাচু অবশ্য এ দিনের ৬২ রানে অন্তত সিডনির পরের টেস্ট পর্যন্ত ভাবনাতেও আক্রান্ত হচ্ছে না। এমনকী পন্টিংয়ের বিপক্ষের পয়লা নম্বর তারকা বোলারও তাঁর মানমর্যাদা অক্ষত রেখে হোটেলে ফিরলেন। তিনিজাহির খান। প্রথম দু’টো স্পেলে ১২৫-১২৮ কিমি গতিতে যখন বল করছেন, তখন দেখলাম সৌরভ-আক্রম প্রবল দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন।
আক্রম: কত বয়স ওর?
সৌরভ: তেত্রিশ।
আক্রম: জেনুইন তেত্রিশ?
সৌরভ: জেনুইন।
আক্রম: তেত্রিশ বছরে এত স্পিড কমে যায় কী করে!
সৌরভ: বুঝতে পারছি না ফিটনেস ঠিক আছে কি না?
তখন ভারতীয় বোলিং বলতে একমাত্র উমেশ যাদব। চব্বিশ বছর বয়স। বাবা কয়লাখনির কর্মচারী। ব্র্যাডম্যান স্মারক বক্তৃতায় দ্রাবিড় বিদর্ভের এই ছেলেটির কথা উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, ‘বিদর্ভের কী প্রত্যন্ত এলাকা থেকে উঠে এসেছে উমেশ। পুলিশকর্মী হওয়া ছিল জীবনের স্বপ্ন। সেখান থেকে ক্রিকেটের মোহে পড়ে এই পেশায় চলে এল। ওর মহল্লায় যা জীবনেও কেউ কখনও পারেনি।’
মেলবোর্ন জীবনের মাত্র তৃতীয় টেস্ট। আর সেখানেই কিনা স্পিড গান-এ ঘণ্টা পিছু দেড়শো কিলোমিটার গতি তুললেন উমেশ। আজ পর্যন্ত ভারতীয় ফাস্ট বোলারের গতির রেকর্ড আশিস নেহরার। ডারবানে ১৫১ কিমি। ফিটনেস ঠিক রাখতে পারলে উমেশের হাতেই রেকর্ডটা চলে আসা উচিত। অস্ট্রেলিয়ার বুকে ভারতীয় পেসার এমন গতিতে বল করছে ভাবাই যায় না! প্রায় সেরকমই কামব্যাক করলেন পুরনো বলে জাহির খান। একটা সময় তো চলে গিয়েছিলেন বক্সিং ডে হ্যাটট্রিকের মুখে।
মাত্র একটা দিনের খেলাতেই টেস্ট নিয়ে আপাত অবাস্তব যা সব কাণ্ডকারখানা হচ্ছে, তাতে আগামী ক’দিনে না সৌরভ আর গ্রেগ চ্যাপেলের মুখোমুখি দেখাও হয়ে যায়!
|
মেলবোর্নের স্কোর |
অস্ট্রেলিয়া
প্রথম ইনিংস: |
কাওয়ান ক ধোনি বো অশ্বিন ৬৮
ওয়ার্নার ক ধোনি বো উমেশ ৩৭
মার্শ ক কোহলি বো উমেশ ০
পন্টিং ক লক্ষ্মণ বো উমেশ ৬২
ক্লার্ক বো জাহির ৩১
হাসি ক ধোনি বো জাহির ০
হাডিন ব্যাটিং ২১
সিডল ব্যাটিং ৩৪
অতিরিক্ত ২৪
মোট ৮৯ ওভারে ২৭৭-৬।
পতন: ৪৬, ৪৬, ১৫৯, ২০৫, ২০৫, ২১৪।
বোলিং: জাহির ২৩-৫-৪৯-২, ইশান্ত ২০-৬-৪০-০, উমেশ ২০-৪-৯৬-৩, অশ্বিন ২৬-২-৭১-১। |
|
|