সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা অধিবেশনের শেষ দিনটি শেষ হয়েছিল সরকার ও বিরোধীদের তীব্র বাদানুবাদে। কিন্তু তার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই দলীয় কর্মীদের প্রকাশ্য সভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশংসা করলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। শনিবার দলের মুর্শিদাবাদ জেলা সম্মেলনের কর্মিসভায় বহরমপুর এফইউসি মাঠে সূর্যবাবু
বলেন, “রাজ্যে বিধান পরিষদ গঠন করার বিষয়ে আমরা আপত্তি তুলেছিলাম। আমাদের আপত্তিতেই হোক বা অন্য কারও
পরামর্শেই হোক, বিধান পরিষদ তিনি (মুখ্যমন্ত্রী) করেননি। এটা তাঁর সৎবুদ্ধি। এটা ভাল কাজ।”
তবে দলীয় কর্মীদের ‘চাঙ্গা’ করতে মুখ্যমন্ত্রীকে কটাক্ষও করেন তিনি। সূর্যকান্তর অভিযোগ, বিষমদ-কাণ্ডে মূল অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে মুখ্যমন্ত্রী ভয় পাচ্ছেন! তিনি বলেন, “প্রায় ২১ বছর আগে ঘটেছে বর্ধমানের সাঁইবাড়ি কাণ্ড। ঘটনার সঙ্গে যুক্ত অনেকে মারাও গিয়েছে। তবু বিনয় কোঙার, নিরুপম সেনকে নিয়ে টানাটানি হচ্ছে। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে বর্তমান সরকার সুশান্ত ঘোষকে জেলে ঢুকিয়েছে। সুশান্তকে ধরতে পারে, আর বিষমদ-কাণ্ডে মূল অভিযুক্তকে ধরতে মুখ্যমন্ত্রী ভয় পাচ্ছেন কেন?” |
মুখ্যমন্ত্রী মমতা অবশ্য এ দিনও তাঁর অবস্থানে ‘অনড়’। বস্তুত, এ দিন মুখ্যমন্ত্রী (যিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রীও) এসএসকেএম হাসপাতালে ইঁদুরের কামড়ে মুমূর্ষু রোগীর মৃত্যুর ঘটনার বিষয়েও নাম না-করে ওই ঘটনায় সিপিএমের ‘চক্রান্তে’র অভিযোগ করেছেন। মহাকরণে এ দিন রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির লক্ষ্যে একগুচ্ছ নতুন প্রকল্প ঘোষণা করার ফাঁকেই মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “হাসপাতালে ইঁদুর ছেড়ে দিয়ে এসে সেই ইঁদুরের কামড়ে রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে এখন প্রচার চালানো হচ্ছে। ইঁদুর ছেড়ে তা নিয়ে খবর তৈরি করানো হচ্ছে। অথচ, এই বাম নেতারাই কোথাও আগুন লাগার খবর পেলে ঘটনাস্থলে যেতেন না। রাস্তায় জল জমলে পরিস্থিতি দেখতে যেতেন না। দাঙ্গা হলে ঘরে বসে থাকতেন!”
মমতার কথায়, “পক্ষান্তরে আমাদের সরকার সংবেদনশীল সরকার। মানুষের সুখেদুঃখে পাশে থাকার সরকার। কোথাও বিপদ-আপদের খবর পেলেই আমরা রাত দুটো হোক, তিনটে হোক, ছুটে যাই। সে-জন্যই ওঁদের (বামফ্রন্টের নেতাদের) মাথাব্যথা। ফের রাজ্য রাজনীতিতে ফিরে আসার জন্য ওঁরা খালি ধর্মঘট, হরতালের রাস্তায় এগোচ্ছেন। করতালি দিয়ে হরতালকে ডেকে আনছেন।”
বিধানসভার অধিবেশন চলাকালীন মগরাহাটে চোলাই মদে বিষ ও নোদাখালিতে পানীয় জলে বিষ থাকার ‘গুজবে’র জন্য সিপিএমকেই সরাসরি দায়ী করেছিল সরকারপক্ষ। শুক্রবার আমরি-কাণ্ডেও সিপিএম ‘প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে’ দোষী বলে অভিযোগ করেন রাজ্যের বর্ষীয়ান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। এ বার এসএসকেএমে ইঁদুরের কামড়ে মুমূর্ষু রোগীর মৃত্যুর ঘটনাতেও প্রধান বিরোধীদলকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন মমতা।
সেই প্রেক্ষিতে সূর্যবাবুর এ দিনের বক্তব্য অবশ্যই ‘ব্যতিক্রমী’। কারণ, শুক্রবারেই বিরোধী দলনেতা মুখ্যমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, “ওঁর জিভে বিষ আছে!” তবে প্রশংসার পাশাপাশিই এ দিন সরকারকে ‘কটাক্ষ’ও করেছেন বিরোধী দলনেতা।
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সূর্যবাবু একইসঙ্গে আশাবাদী যে, ‘পরিবর্তন’-এর পরিবর্তনও সম্ভব। সে জন্য নিজেদের ‘পরিবর্তন’ চান তিনি। তাঁর কথায়, “সারা দুনিয়া জুড়ে সংসদীয় গণতন্ত্রে পরিবর্তন হয়। এটাই স্বাভাবিক। এ রাজ্যেও ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এটাকে অনেকে ঐতিহাসিক বলছেন। এটা ঐতিহাসিক নয়। ৩৪ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা, পর পর সাত বার নির্বাচনে জেতাটাই ঐতিহাসিক। ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পরেও শতকরা ৪১ ভাগ ভোট পেয়েছি আমরা। এটাই ঐতিহাসিক ঘটনা। পৃথিবীর ইতিহাসে এটা নেই!”
একইসঙ্গে বিরোধী দলনেতা বলেন, “পরিবর্তনেরও পরিবর্তন সম্ভব। তবে তার জন্য পাটির কর্মীদের নিজেদের পাল্টাতে হবে। আমাদের বিরুদ্ধে যাঁরা চলে গিয়েছেন, তাঁদের দোষ দেবেন না। আমাদের দোষ দেবেন। নিজেদের দোষ খুঁজে বের করতে হবে। আগে নিজেদের পরিবর্তন করতে হবে।”
তবে দলের ‘পরিবর্তন’-এর জন্য ‘শুদ্ধকরণে’র প্রয়োজন মনে করিয়ে দেন সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা। দলের দুই প্রথমসারির নেতা মদন ঘোষ ও সূর্যবাবুকে পাশে বসিয়েই ‘শুদ্ধকরণ’ প্রসঙ্গে নেতাদের কটাক্ষ করেন তিনি। তাঁর কথায়, “আমাদের দল নেতা নির্ভর নয়। ক্যাডার ভিত্তিক। কাজের ফারাক থাকলেও দলে সকলেই সমান। এটি মাঝে মাঝে আমাদের নেতাদের মাথায় থাকে না। এর জন্য গণ্ডগোল হয়। লণ্ডন-ফেরত, অক্সফোর্ড-ফেরত, প্রচুর লেখাপড়া করা মানুষ না-হলে নাকি নেতা হয় না! আমাদের ভুল হয়েছে সত্যি কথা। কিন্তু মাছের মাথা প্রথমে পচে। তাই প্রথমে রাজ্য কমিটির সংশোধন দরকার। তার পর জেলা কমিটি, পরে জোনাল কমিটি। তার পর লোকাল কমিটির সংশোধন করতে হবে। যত বড়ই নেতা হোন, তাঁকে গ্রামে যেতে হবে। মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে, তাঁদের বাড়িতে রাতে থাকতে হবে। গাড়ি করে গেলাম, গাড়ি করে চলে এলাম এ সব চলবে না।”
চতুর্থ বামফ্রন্ট সরকার থেকে ‘দল ও সরকারে ভেজাল’ ঢুকতে শুরু করেছে জানিয়ে রেজ্জাক মোল্লা বলেন, “১৯৬৮ সাল থেকে পার্টির মতাদর্শগত দলিল তৈরি হয়নি। এটি দলের বড় সমস্যা। তার পর এ বার দলিল তৈরি হচ্ছে। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট প্রথম ক্ষমতায় আসার সময় দলের সদস্যসংখ্যা ছিল ২৮ হাজার। এখন বেড়ে হয়েছে ৩ লাখ ২২ হাজার। সদস্য বাড়লেও পার্টির গুণগত মান বাড়েনি। যে যার মতো দলে ঢুকে গিয়েছে।” |
সিপিএম কর্মী খুন কান্দিতে
নিজস্ব সংবাদদাতা • কান্দি |
দুষ্কৃতীদের বোমা-গুলিতে মৃত্যু হয়েছে এক সিপিএম কর্মীর। নাম ইউসুফ শেখ (৪২)। বাড়ি মুর্শিদাবাদের কান্দি থানা এলাকার উদয়চাঁদপুর গ্রামে। পুলিশ জানিয়েছে, শনিবার সন্ধ্যায় কাজ করে বাড়ি ফেরার সময় পেয়ারকাটা গ্রামের কাছে পেশায় ঠিকাদার ইউসুফকে লক্ষ্য করে বোমা-গুলি ছোড়ে দুষ্কৃতীরা। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁর। কান্দি জোনাল কমিটির সম্পাদক কাজল চক্রবর্তী বলেন, “নিহত ওই ব্যক্তি আমাদের দলের সদস্য ছিলেন। কে বা কারা তাঁকে কেন খুন করেছে, বুঝতে পারছি না।” |