কোন কোন ‘লাভজনক পদে’ থাকলে বিধায়ক-পদ খারিজ হবে না, তার পরিধি আরও প্রসারিত করতে বিল আনছে রাজ্য সরকার। কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার অনুমোদিত কোন কোন কমিটি এবং সংস্থার নেতৃত্বে বা সদস্য হিসাবে বিধায়কেরা থাকতে পারবেন, সেই সীমারেখাই নতুন করে টানা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট আইনে সংশোধনী এনে। রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের আশঙ্কা, এর ফলে ভিন্ন চেহারায় ‘দলতন্ত্র’ ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকবে। বিভিন্ন সংস্থা বা কমিটিতে সরকার তাদের ‘পছন্দমতো’ জনপ্রতিনিধিদের বসাতে পারবে। বিধায়ক-পদ এবং ওই অতিরিক্ত দায়িত্বের মধ্যে কোনও ‘সংঘাত’ বাধবে না।
বিধানসভায় আজ, বুধবারই ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল লেজিসলেচার (রিমুভ্যাল অফ ডিজকোয়ালিফিকেশন্স) অ্যামেন্ডমেন্ট, ২০১১’ শীর্ষক বিলটি পেশ হওয়ার কথা। বামফ্রন্ট জমানায় ২০০৭ সালে এই সংক্রান্ত যে আইন পাশ হয়েছিল, তার উপরেই সংশোধনী আনতে চাইছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। সংশ্লিষ্ট দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসাবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ওই বিলের উদ্দেশ্য এবং যুক্তি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন, বিধায়ক থাকাকালীন জনপ্রতিনিধিরা কোন কোন পদে বসতে পারবেন, সেই তালিকায় আরও সংযোজন ‘প্রয়োজনীয়’। সেই প্রক্রিয়া ‘ত্বরান্বিত’ করতেই বিলটি আনা হচ্ছে। পূর্বনির্দিষ্ট তালিকার সঙ্গে নতুন বিলে যে পদগুলি অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে, সেগুলিতে থাকার জন্য বিধায়ক-পদ খারিজ হবে না।
বর্তমান আইনে ১১৫টি ক্ষেত্রকে ‘লাভজনক পদে’র আওতা থেকে বাদ রাখা আছে। নতুন বিলে তার সঙ্গে আরও ১১টি ক্ষেত্রকে জুড়ে সংখ্যাটি ১২৬-এ দাঁড়াচ্ছে। যার মধ্যে বিভিন্ন সমবায় ব্যাঙ্ক, ক্রেতা সমিতি, সমবায় হিমঘর সমিতি থেকে শুরু করে সেন্ট্রাল স্কুল সার্ভিস কমিশন, রিজিওনাল স্কুল সার্ভিস কমিশন, শিশু কিশোর অ্যাকাডেমি পর্যন্ত আছে! রাজনীতিকদের একাংশের ব্যাখ্যা, স্কুল সার্ভিস কমিশন থেকে শুরু করে সরকার অনুমোদিত বিভিন্ন সংস্থা বা কমিটিতেই এ বার থেকে বিধায়কদের রাখা যাবে। তার ফলে, ঘুরপথে ‘দলতন্ত্র’ই প্রতিষ্ঠিত হবে। যার আইনি বৈধতা নিয়ে রাখা হচ্ছে ওই বিল পাশ করে। বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় বিল পাশ করাতে শাসক শিবিরকে কোনও অসুবিধাতেও পড়তে হবে না।
তৃণমূল শিবিরের অবশ্য যুক্তি, এর সঙ্গে ‘দলতন্ত্রে’র কোনও সম্পর্ক নেই। প্রধান শাসক দলের এক বিধায়কের কথায়, “নানা ক্ষেত্রে নানা কমিটি বা সংস্থায় উপদেষ্টা হিসাবে বিধায়কেরা থাকেন। কখনও এই নিয়ে মামলা হলে যাতে কোনও সমস্যায় পড়তে না-হয়, তার জন্যই বর্তমান আইনের আওতায় আরও কিছু ক্ষেত্র ঢোকানো হচ্ছে।” কিন্তু তাও প্রশ্ন থাকছে, শিক্ষা-সহ নানা ক্ষেত্রে ‘দলতন্ত্রে’র অবসান ঘটানো যে সরকারের ঘোষিত লক্ষ্য, তারাই জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ‘দলের নিয়ন্ত্রণ’ বজায় রাখার রাস্তা খুলে রাখতে ‘সচেষ্ট’ হবে কেন? ‘দলতন্ত্রে’র অভিযোগ যাদের জমানায় বার বার উঠত, সেই বামফ্রন্ট অবশ্য বিলটিতে ‘বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ’ কিছু দেখছে না। রাজ্যের এক প্রাক্তন মন্ত্রী এবং বাম বিধায়কের বক্তব্য, “আমাদের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের নানা কমিটি থেকে বিভিন্ন পর্ষদে জনপ্রতিনিধিরা থাকতেন। কিন্তু ভোটে লড়ার সময় আমরা সেই সব পদ থেকে ইস্তফা দিতাম। মুখে অনেক কথা বললেও আইন করে ‘দলতন্ত্র’ কখনও আটকানো যায় না! আসল কথা হল নীতি।”
বিলে বলা হয়েছে, বর্তমান আইনের ২ নম্বর অনুচ্ছেদে ‘জি’ ধারায় যে ব্যাখ্যা আছে, তার সঙ্গে ‘জি এ’ ধারা সংযুক্ত হবে। নতুন ধারায় বলা হচ্ছে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার অনুমোদিত কোনও কমিটি, পর্ষদ, অছি পরিষদ, বিধিবদ্ধ বা অবিধিবদ্ধ সংস্থা প্রভৃতির চেয়ারপার্সন, সদস্য বা নির্দেশক ‘ছাড়ে’র আওতায় আসবেন। শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলা, সংবাদমাধ্যমের (‘প্রেস অর মিডিয়া’) মতো ‘জনজীবনে গুরুত্বপূর্ণ’ ক্ষেত্রে ‘পরামর্শ, তথ্য সংগ্রহ’ ইত্যাদি ভূমিকায় কাজ করলে বিধায়ক-পদ খারিজের বিধি খাটবে না।
সরকারের শরিক কংগ্রেসের এক বর্ষীয়ান বিধায়কের কথায়, “এক সময় শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কতৃর্পক্ষের (এসজেডিএ) মতো সংস্থার সদস্য হতে গেলেও বিধায়কদের পৃথক অনুমতি নিতে হত। এখন সরকার বিধায়কদের জন্য এই ক্ষেত্রগুলিকে আরও প্রসারিত করতে চাইছে।” যার সূত্রে কংগ্রেসেরই অন্য এক বিধায়কের আশঙ্কা, “কোন কোন পদ লাভজনকের আওতা থেকে বাদ যাবে, তার তালিকা বাড়াতে থাকলে কিন্তু এর কোনও শেষ নেই! সংবাদমাধ্যম থেকে চলচ্চিত্র, যে কোনও বিষয়ে পরামর্শদাতা কমিটিতে বিধায়ক বসে পড়তে পারবেন! অমুক পদ কেন ছাড় পাবে না, সেই প্রশ্নও উঠতে থাকবে!” মমতার আমলে যে হেতু একের পর এক কমিটি এবং কমিশন হয়েছে, তাই এই ‘আশঙ্কা’র কথা আরও বেশি করে উঠছে রাজনৈতিক শিবিরে। |