আক্ষেপটা বারবার উঠে আসছিল তাঁর মুখে। “আমরি-তে পৌঁছে সে দিন বেসমেন্টে না গিয়ে যদি উদ্ধারের কাজ শুরু করতাম, অনেক মানুষের প্রাণ বাঁচানো যেত!”
বুধবার কালীঘাট ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে বসে বলছিলেন সুধাংশুকুমার দাস। তিনিই দমকলের প্রথম অফিসার, যিনি গত শুক্রবার ভোরে প্রথমে পৌঁছেছিলেন আমরি হাসপাতালে। দমকলের ওই সাব-অফিসার জানান, “হাসপাতালের লোক এত দায়িত্বজ্ঞানহীন হবে, কে ভেবেছিল!” কী ঘটেছিল তখন? সুধাংশুবাবু বলছিলেন, “এত ধোঁয়া যে বাড়িটার সামনেই তখন দাঁড়ানো যাচ্ছে না। ভিতরের রোগীদের কী হয়েছে, ভেবে বুকটা ছাঁৎ করে উঠেছিল। কিন্তু হাসপাতালের নিরাপত্তাকর্মীরা আমাদের সটান বেসমেন্টের দিকেই ঠেলে দিলেন।” দমকলের ওই অফিসার বলেন, “সবার আগে মানুষগুলোকে বার করাই ছিল কর্তব্য। কিন্তু হাসপাতালের লোকেদের কথা শুনে আমরা একেবারে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম।”
|
সুধাংশুকুমার দাস |
শুক্রবার, ভোর ৪টে ১০ মিনিট। পুলিশের কাছ থেকে খবর পেয়ে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে দমকলের কন্ট্রোলরুম মারফত আমরির খবরটা পৌঁছয় কালীঘাট স্টেশনের সাব-অফিসার সুধাংশুবাবুর মোবাইলে। ওই রাতে আমরির নিকটবর্তী গড়িয়াহাট দমকলকেন্দ্রের কোনও অফিসার ডিউটিতে ছিলেন না। সুধাংশুবাবুর নেতৃত্বে কালীঘাট ও গড়িয়াহাট দমকলকেন্দ্রের একটি দল তখন বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট প্লেসের একটি চারতলা বাড়িতে লিফটের আগুন নেভাচ্ছিলেন। সুধাংশুবাবুর কথায়, “খবরটা পেয়েই কালীঘাটের একটি গাড়ি ও গড়িয়াহাটের দু’টি গাড়ি নিয়ে আমরিতে রওনা দিই।”
আমরিতে পৌঁছে সুধাংশুবাবু কী দেখলেন? তিনি বলেন, অন্ধকার ও জমাট ধোঁয়ায় কিচ্ছু ঠাহর হচ্ছিল না। ভিড় ছিল। কিন্তু বাড়িটায় আলোজ্বলছিল না। তিনি বলেন, “তেতে গনগনে বেসমেন্টটায় জল দেওয়া শুরু করেই উপরে একটা কাচ ভাঙার শব্দ পাই। তখনই বুঝি, রোগীরা ভিতরে আটকে।”
সুধাংশুবাবুর সঙ্গী কালীঘাটের ফায়ার অপারেটর সুমিত দাস বা গড়িয়াহাটের শুভজিৎ মৈত্র, বিক্রম সাউ, সুমনকুমার সিংহরা এ দিন বলছিলেন, আওয়াজ পেয়ে বেসমেন্ট থেকে বেরিয়ে উপরে তাকাতেই অন্ধকারে আবছা চোখে পড়ে হাসপাতালের জানালা অল্প ফাঁক করে মুখ বাড়িয়ে কেউ কেউ শ্বাস নিচ্ছেন। কেউ বা মোবাইলের টিমটিমে আলো জ্বেলেই নিজের উপস্থিতি বোঝানোর চেষ্টা করছেন।
সুধাংশুবাবুর বার্তা পেয়েই দমকলের কন্ট্রোলরুম যন্ত্রচালিত মই, বাড়তি ইঞ্জিন পাঠানোর নির্দেশ দেয়। কিন্তু তত ক্ষণে আরও সময় পেরিয়েছে। দমকলের নথি বলছে, ৪টে ২২ মিনিটে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট থেকে রওনা দেন সদর দফতরের স্টেশন-অফিসার সুমিত শূর। সুমিতবাবু জানাচ্ছেন, তিনি গোলপার্কের মোড়ে পৌঁছতে পৌঁছতেই উঁচু মই বা টার্নটেবল ল্যাডার রওনা হওয়ার কথা জানতে পারেন।
হাসপাতালের ভিতরে দমকল গিয়ে কোথায় দাঁড়াবে, সেই ব্যবস্থাটাও হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ করে রাখেনননি বলে অভিযোগ সুধাংশুবাবুর। তাঁরা বলেন, ভোর সাড়ে চারটের পরেও হাসপাতালের নিজস্ব গাড়িগুলি সঙ্কীর্ণ পরিসর থেকে সরানো হয়নি। গাড়ি সরাতেও সময় নষ্ট হয়েছে অনেকটা। সুধাংশুবাবু বলেন, “৩৫ ফুট উঁচু দু’টো মই দিয়েই প্রথমে বিপন্নদের বার করার চেষ্টা করি। বাড়িটির পিছনে বাঁশের ভারা বেয়ে পঞ্চাননতলার বাসিন্দারাও একই ভাবে উদ্ধার চালাচ্ছিলেন। আমাদের সঙ্গে শ্বাসযন্ত্র ছিল না তখন।”
সুধাংশুবাবুর সঙ্গী ৫৫ বছরের সাব-অফিসার বিশ্বেশ্বর চক্রবর্তী শ্বাসযন্ত্র ছাড়াই ঢুকেছিলেন। তাঁর কথায়, “ধোঁয়া আর অন্ধকার ঠেলে উঠে দেখি, ভেন্টিলেশন যন্ত্রে বন্দি রোগীরা বিছানায় পড়ে। তাঁদের বার করতে না-পেরে মূল ভবনে ঢুকে ডাক্তার-নার্সের সাহায্য চাই। গোড়ায় কয়েক জন এলেও পরে তাঁদের দেখলাম না। দ্বিতীয়বার ঢুকে তিন জন রোগীকে বার করে তোষকে শুইয়ে দিই। পাড়ার ছেলেরা তাঁদের বাইরে নিয়ে যান।” ৭-৮ বারের পরে বিশ্বেশ্বরবাবু অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ হন ফায়ার অপারেটর বিক্রম সাউও। বিশ্বেশ্বরবাবুর কথায়, “কার্বনে জিভ কালো হয়ে গিয়েছিল। বারবার বমি হচ্ছিল।”
তবে দমকল কর্মীরা সকলেই বলছিলেন, এ সবই তো সইত, যদি আরও কয়েক জনকে বাঁচানো যেত! কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সাহায্যই তো মেলেনি। |