বিষ মদে ফের মৃত্যুমিছিল, মৃত ৫৭, অসুস্থ ৯৫
চোলাইয়ের রমরমা বাড়ছে, রাজ্য কিন্তু সেই ‘রক্ষণশীল’
রাজ্যের ‘অতি রক্ষণশীল মদ-নীতি’-কে ফের প্রশ্নের মুখে ফেলে চোলাই মদের বিষক্রিয়ার প্রাণ হারালেন অন্তত ৫৭ জন। মগরাহাট, উস্তি ও মন্দিরবাজার এলাকার এই ঘটনায় অসুস্থের সংখ্যা ৯৫। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা। বুধবার এই ঘটনার পরে দুপুর নাগাদ প্রশাসন নড়েচড়ে বসে মগরাহাট স্টেশন সংলগ্ন চোলাই মদের ভাটিগুলি একের পর এক ভেঙে দেয়। কিন্তু নীতি বদল না হলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে বলে মনে করছেন রাজ্য প্রশাসনের একাংশই।
কারণ, চোলাই মদ খেয়ে মৃত্যুর ঘটনা এ রাজ্যে নতুন নয়। ২০০৯ সালে কলকাতা বন্দর এলাকায় চোলাই খেয়ে মারা গিয়েছিলেন ২৬ জন। ওই বছরই পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা সদর তমলুকে প্রাণ গিয়েছিল ৫২ জনের। তাতেও যে সরকারের ‘হুঁশ’ ফেরেনি এ দিন তা ফের স্পষ্ট হয়ে গেল। প্রথমত, গত ছ’মাসে ওই সব এলাকায় চোলাই বিরোধী কোনও অভিযানই হয়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তার উপর মগরাহাট এলাকা থেকে সরকার অনুমোদিত দেশি মদের দোকানও অন্তত ২০ কিলোমিটার দূরে জিয়াগঞ্জ-রাজাহাটে। তাই স্থানীয়দের বক্তব্য, বেআইনি চোলাই যাঁরা খেয়েছেন, তাঁদের ওই চোলাইয়ের উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায়ও ছিল না।
ডায়মন্ড হারবার হাসপাতাল থেকে কলকাতায় আনা হচ্ছে বিষ-মদে অসুস্থ রোগীকে।
কী হয়েছিল এ দিন মগরাহাটে?
স্থানীয়রা জানান, বমি, চোখ জ্বালা, সারা গায়ে খিঁচুনি— এমন উপসর্গ নিয়ে ভোর থেকেই একের পর এক অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন খাপুর, কচুয়াপাড়া, সংগ্রামপুর, কালিকাপোতা, সংগ্রামপুরহাট, ভারি-১, গড়িজল, বামনাপাড়া, সেকেন্দরপুর, ধান্যকাটা-সহ আশপাশের বেশ কিছু গ্রামের বাসিন্দা। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই মারা যান বেশ কয়েক জন। পরে হাসপাতালে মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। মৃত ও অসুস্থদের অধিকাংশই পেশায় দিনমজুর, ভ্যান বা রিকশাচালক। পুলিশ জানায়, ওই সব লোকেরা সাধারণত সংগ্রামপুর স্টেশন সংলগ্ন একটি ঠেকে গিয়ে মদ খান অথবা সেখান থেকে মদ কিনে বাড়িতে নিয়ে যান। মদ খাওয়ার পর থেকেই তাঁরা অসুস্থ হতে শুরু করেন।
অসুস্থদের অনেককে প্রথমে মগরাহাট প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তাঁদের ডায়মন্ড হারবার মহকুমা হাসপাতালে ‘রেফার’ করা হয়। ভ্যান রিকশা, মোটর ভ্যান, অটোয় করে একের পর এক অচেতন দেহ হাসপাতালে পৌঁছতে থাকে। তার পরেই পুলিশ ও প্রশাসনের তরফে তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। হাসপাতালে অল্প শয্যা ও কম জায়গা থাকায় একসঙ্গে এত রোগীর চিকিৎসা করতে সমস্যায় পড়েন কর্তৃপক্ষ। তখন জরুরি ভিত্তিতে আশপাশের স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে চার জন, বাঙুর হাসপাতাল থেকে চার জন এবং ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ থেকে তিন জন চিকিৎসককে আনা হয়। আনা হয় বেশ কয়েক জন নার্সকেও। তাতেও অবশ্য মৃত্যু-মিছিল ঠেকানো যায়নি। বাঙুর হাসপাতালেও নিয়ে যাওয়া হয় অসুস্থ কয়েক জনকে। সেখানে মারা যান ৯ জন।
পরে চার জন চিকিৎসক ময়না-তদন্তের কাজ শুরু করেন। আলিপুর কাঁটাপুকুর মর্গ থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার এসিএমওএইচ উমাপ্রসন্ন ঘোষালের নেতৃত্বে আরও একটি ময়না-তদন্তকারী দল ডায়মন্ড হারবারে পৌঁছয়। রাতে মর্গের সামনের মাঠে ফ্লাডলাইট জ্বালানো হয়। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, একটা করে দেহের ময়না-তদন্ত হচ্ছে, মাইকে মৃতের নাম ঘোষণা করা হচ্ছে, তার পর দেহগুলি মাঠে রাখা গাড়িতে তুলে দেওয়া হচ্ছে।
ওই চোলাই মদ খেয়ে কেন এত জন মারা গেলেন তা অবশ্য বুঝে উঠতে পারেননি আবগারি দফতর ও পুলিশের কর্তারা। আবগারি দফতরের এককর্তা বলেন, “আগে চোলাইয়ের সঙ্গে মিথাইল অ্যালকোহল (কাঠে রং করার কাজে ব্যবহৃত) মিশিয়ে দেওয়ায় বিষক্রিয়া ঘটত। ওই ভেজাল ঠেকানোর জন্য এখন মিথাইল অ্যালকোহলে নীল রং মেশানো হচ্ছে। তাই ওই রাসায়নিক ব্যবহার করা হলে ক্রেতারাই বুঝতে পারবেন।” এর পরেও চোলাই খেয়ে কেন এত জনের মৃত্যু হল, তা জানার জন্য ওই মদের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে বলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
বিষ মদে মত্যু হয়েছে স্বামীর। কান্নায় ভেঙে পড়েছেন হারুন সর্দারের শোকার্ত স্ত্রী।
এ দিন মহাকরণে রাজ্যের মুখ্যসচিব সমর ঘোষ বলেছেন, “চোলাই মদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশি তদন্ত চলছে।” মৃতদের পরিবারকে ২ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে বলে বিধানসভায় জানিয়েছেন রাজ্যের পরিষদীয় দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়।
কিন্তু কেন এ ভাবে চোলাই মদ খেয়ে বারবার মরতে হচ্ছে মানুষকে? আবগারি দফতরের কর্তারাই জানাচ্ছেন, সম্প্রতি রাজ্যে দেশি ও চোলাই মদের বিক্রি মারাত্মক ভাবে বেড়েছে। তাঁদের হিসেব অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে শুধু দেশি মদের বিক্রিই ৩০% বেড়েছে। চোলাইয়ের বিক্রি কতটা বেড়েছে তার হিসেব পাওয়া অবশ্য সম্ভব নয়, কারণ ওই মদের পুরো ব্যবসাটাই বেআইনি। তবে আবগারি দফতরের এক কর্তা বলেন, “কোথাও এলাকায় চোলাই মদের বিক্রি ৫০%-এরও বেশি বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে।”
কেন বিক্রি বাড়ছে দেশি ও বেআইনি চোলাই মদের? আবগারি দফতরের কর্তারা জানিয়েছেন, চলতি অর্থবর্ষের অক্টোবরে বিদেশি মদের উপরে কর বসানোর পর থেকেই ওই মদের দাম মারাত্মক ভাবে বেড়েছে। এর ফলে যে সব নিম্নবিত্ত মানুষ কম দামের বিদেশি মদ কিনতেন, তাঁরা এখন দেশি ও চোলাই মদের দিকে ঝুঁকেছেন। ওই কর্তার কথায়, “আগে সব চেয়ে কম দামের বিদেশি মদের (রাম) ছোট বোতল ৫৫ টাকার মধ্যে মিলত। কর বসানোর পরে ওই মদের দাম বেড়ে হয়েছে প্রায় ৮০ টাকা। রাজ্য সরকার দেশি মদের উপরে কর বসায়নি। তাই ওই মদ এখনও বোতলপিছু ২৪ টাকা থেকে ৫২ টাকার মধ্যেই (শক্তি বা ‘স্ট্রেন্থ’ অনুযায়ী) মেলে। ওই পরিমাণ চোলাই মদের দামও কম-বেশি ২৫ টাকার মধ্যেই।
সরকার অনুমোদিত দেশি মদ এবং বেআইনি চোলাই মদের দাম মোটামুটি কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ কেন বিপজ্জনক চোলাই মদের দিকেই ঝুঁকছেন?
চোলাই ঘাঁটি
উত্তর ২৪ পরগনা: বিলকান্দা, তালবান্দা ও বসিরহাটের একাধিক এলাকা
দক্ষিণ ২৪ পরগনা: গোচরণ, পৈলান, ডায়মন্ড হারবারের একাধিক এলাকা
হাওড়া: রথতলা, কালিতলা ও শ্যামপুর
হুগলি: সিঙ্গুর, দিয়ারা ও নসিবপুর
পূর্ব মেদিনীপুর: কুরপাই, মহম্মদপুর, বরাহ চণ্ডীপুর, রাধাবল্লভ চক, কোলাঘাট ও শান্তিপুর
বিষমদ: মৃত্যুর খতিয়ান
১৯৯৫ হুড়া, পুরুলিয়া মৃত ১২
জানুয়ারি, ২০০৯ খিদিরপুর মৃত ২৬
মে, ২০০৯ তমলুক মৃত ৫২
১৪ ডিসেম্বর, ২০১১ মগরাহাট ও উস্তি মৃত ৫৭
আবগারি দফতরের কর্তারা জানিয়েছেন, এর কারণ সরকারের ‘ভ্রান্ত মদ-নীতি’। আগের সরকারও দেশি মদের বিক্রি বাড়াতে আগ্রহী ছিল না। তাই নিম্নবিত্ত ও অতি নিম্নবিত্তদের মধ্যে দেশি মদের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সরকার পর্যাপ্ত সংখ্যক দোকান খোলার অনুমতি দেয়নি। ২০০৫ সালে সরকার কিছু দেশি মদের দোকান খোলার অনুমতি দেয়। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, বর্তমানে গোটা রাজ্যে সরকার অনুমোদিত দেশি মদের দোকানের সংখ্যা মাত্র ১২০৯টি। আবগারি দফতরের এক অফিসার বলেন, “এই কয়েকটি দোকানের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ ক্রেতার কাছে দেশি মদ পৌঁছে দেওয়া কার্যত অসম্ভব। কিন্তু দেশি মদের দোকান বাড়ালেই বিতর্কে জড়িয়ে পড়তে হবে--- এই আশঙ্কা থেকেই বাস্তব পরিস্থিতিকে অস্বীকার করা হয়েছে। নতুন সরকার এসেও এই পরিস্থিতি বদলাতে উদ্যোগী হয়নি। বরং বিদেশি মদের দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় দেশি মদের ক্রেতার সংখ্যা আরও বেড়েছে।”
অথচ সেই দেশি মদের দোকানও বিপুল সংখ্যক ক্রেতার ধারে-কাছে নেই। যেমন মগরাহাটের ওই এলাকা। ফলে হাতের কাছে সহজে পেয়ে যাওয়া চোলাই মদই কিনতে বাধ্য হচ্ছেন ক্রেতারা। আবগারি দফতরের এক কর্তা বলেন, “বেআইনি ভাবে তৈরি চোলাই মদ কখনওই সরকার অনুমোদিত দেশি মদের বিকল্প হতে পারে না। ওই মদের বোতলও সিল করা থাকে। তাই দেশি মদ খেয়ে এ ভাবে মৃত্যু ঘটারও সম্ভাবনা নেই। চোলাই মদের রমরমা ঠেকাতে তাই দেশি মদের দোকান বাড়াতেই হবে। কিন্তু নীতি-নির্ধারকরা এই সহজ কথাটি বুঝেও বুঝতে চাইছেন না বলেই বারবার এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।”

বুধবার দিলীপ নস্করের তোলা ছবি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.